সচিবালয়ে মধ্যরাতে লাগা এই আগুনের ঘটনা জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন তুলে তার উত্তর খুঁজছেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ।
জানা যায়, সচিবালয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে ঘিরে আন্দোলন করছিলেন কর্মকর্তারা। গত বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি করে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন আমলারা। প্রশাসনে এমন চলমান অস্থিরতার মধ্যে পরদিনই এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ওঠে এসেছে পাঁচ প্রশ্ন।
এক. নিরাপত্তাকর্মীদের দৃষ্টি এড়াল কী করে : সচিবালয়ের কাছে থাকা একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী মনে করছেন, আগুন পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে। তারা বলছেন, সচিবালয়ের ভেতরে শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী ও সকল গোয়েন্দা সংস্থার লোক থাকে। আগুন লাগার পর কি একজনের চোখেও পড়েনি। এটা কীভাবে সম্ভব?
আগুনের ঘটনা নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, সচিবালয়ের ভেতরে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যর্থতা ছিল।
দুই. শর্ট সার্কিট না অন্য কিছু : অন্যদিকে সচিবালয়ে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই সময়ে দুই জায়গায় আগুনের সূত্রপাত দেখে সন্দেহ তৈরি হয়েছে—এটি কি শর্ট সার্কিট না অন্য কিছু। বিষয়গুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন জাগছে বলেও জানান তারা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কেপিআইভুক্ত এলাকা। যদিও এখানে আগেও একাধিকবার আগুন লেগেছে। পিডব্লিউ কাজও করেছে। আবার কেন তাহলে আগুন লাগলো? আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এভাবে কখনো দুর্ঘটনার আগুন লাগে না।’
আলী আহমেদ খান বলেন, ‘দুর্বৃত্তরা যখন আগুন লাগায় তখন একসঙ্গে একাধিক স্থানে আগুন লাগে। এমন দুর্বৃত্তায়নের আগুন আমি আগেও দেখেছি। এখানেও তাই হয়েছে। এটা শর্ট সার্কিট না, আগুন লাগানো হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর সরকারি ছুটি ছিল। হয়তো দুর্বৃত্তরা এই ছুটির সুযোগে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগাতে পারে। এখানে ফায়ার সার্ভিস ছিল। ভেতরে ফায়ার স্টেশন আছে। আর ক্যামেরা তো আছেই। সার্বক্ষণিক দেখভালের লোক আছে। সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে এক বা দুজন লোক ছিল না, দেড়-দুই শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী ছিল। তারা কি সবাই একসঙ্গে ঘুমাচ্ছিল? সেটা তো হতে পারে না।’
তিন. ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতা : ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (অপারেশনস) মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, সচিবালয়ে লাগা আগুন নির্বাপনে ১০ ঘণ্টা সময় নেওয়া অবিশ্বাস্য। সচিবালয়ে আগুন লাগানো হয়েছে। নাশকতার যথেষ্ট কারণ আছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ সেসব জায়গায় আগুন লাগছে। আরেক ভবনে তো আগুনই লাগেনি।
এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘গতকাল ছুটির দিন ছিল। রাত দেড়টায় আগুন লাগল, যেখানে বাইরের মানুষের প্রবেশের সুযোগ নেই। এর মধ্যে একটা পক্ষের ৪০ ঘণ্টার আল্টিমেটাম চলছে। কারা আল্টিমেটাম দিয়েছে তাদের ধরতে হবে। মধ্যরাতে লাগা আগুন নেভাতে ১০ ঘণ্টা লাগলো কেন, তা-ও দেখতে হবে।’
শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘যদি দুর্ঘটনাজনিত আগুন হয়, তাহলে এক জায়গায় লাগার কথা। একসঙ্গে তিন জায়গায় আগুন লাগার কথা নয়। লাগানো হলেই তিন জায়গায় আগুন জ্বলবে। তো পুলিশ, আনসার, বিজিবি ছিল। চারদিকে লাইট বন্ধ ছিল। ফায়ার সার্ভিস কী করল? তাদের কী দুর্বলতা ছিল? বঙ্গবাজার ১০ গজের ভেতরে, সেই আগুনও তারা দ্রুত নেভাতে পারলো না। সচিবালয় কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান, সেখানেও তারা আগুন নেভাতে পারছেন না। এটা হয় না, মানা যায় না। তাদের ব্যর্থতাকেও তদন্তের বিবেচনায় আনতে হবে।’
চার. সচিবালয়ের পোড়া কক্ষে মৃত কুকুর : সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া ৭ নম্বর ভবনের আটতলা থেকে পুড়ে যাওয়া মৃত একটি কুকুর পাওয়া গেছে। পুড়ে যাওয়া ৭ নম্বর ভবনের আটতলায় মৃত কুকুর পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন সেখানে কুকুর গেল কী করে?
এ বিষয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে করা এক পোস্টে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন। তিনি বলেছেন, ‘চাকরি জীবনের ৩০ বছর এবং এখন পর্যন্ত সচিবালয়ের ভেতরে কোনো দিন কুকুর দেখিনি। অথচ ওই বিল্ডিংয়েরে ৮ তলায় পুড়ে যাওয়া মৃত কুকুর পাওয়া গেছে। হোয়াট আ মিজারেবল সিকিউরিটি!’
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে ও দেখতে পেরেছি সেখানে একটি কুকুরের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সচিবালয়ের রুমের ভেতরে কিভাবে একটি কুকুর পাওয়া যেতে পারে। এখানে আরো কোনো চক্রান্ত আছে কি না। ষড়যন্ত্র আছে এটা আমরা নিশ্চিত। কিভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চলছে। সেটিও আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে পর্যবেক্ষণ ও প্রতিহত করতে হবে।’
পাঁচ. ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু : বাংলাদেশ সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাক চাপায় সোহানুর জামান নয়ন (২৪) নামের এক ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। পানির পাইপ নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি ট্রাক তাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।
নয়নকে উদ্ধারকারী তেজঁগাওয়ে কর্মরত আরেক ফায়ার ফাইটার শফিকুল ইসলাম বলেন, সচিবালয়ে সামনের রাস্তায় গাড়ি রাখার পর, পানির পাইপটি কাঁধে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য রাস্তা পার হওয়ার সময় তাকে ধাক্কা দেয় একটি ট্রাক। এ সময় ঘাতক ট্রাকের পেছনের চাকা তার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।
এদিকে, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করার সময় ওই সড়ক বন্ধ করা হয়নি কেন-সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। আবার অনেকেই সোহানুর রহমান নয়নের মৃত্যুতে পুলিশের গাফলতি আছে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন রেখে বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। সচিবালয়ে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটটি আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে রাত ১টা ৫৪ মিনিট থেকে। আগুনের তীব্রতা বেড়ে গেলে একে একে ১৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। শুরুতে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ৮টি ইউনিট কাজ করলেও পরে আরও ১১টি ইউনিট যুক্ত হয়।
সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ছাই হয়ে যাওয়া চারটি ফ্লোরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ছিল। এই চারটি ফ্লোর একেবারে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।