
উদ্দেশ্যমূলকভাবে গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগ ধ্বংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার নাটের গুরু এবিএম খায়রুল হক দেশ ছেড়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেছেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তবে সেখানেও লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার চেষ্টা করছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি দেশেই ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ডিএমপির শাহবাগ থানায় সুনির্দিষ্ট মামলা হওয়ার পরও রহস্যজনক কারণে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ছাড়াও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গত বছরের ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছিল। মামলার বাদী নারায়ণগঞ্জ জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবদুল বারী ভূঁইয়া।
দেশের বিচার বিভাগের উচ্চাসনে বসে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করা ছাড়া তার আর কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল না।
এবিএম খায়রুল হকের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, তিনি প্রথমে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারত থেকে পাড়ি দেন যুক্তরাজ্যে। সেখানে প্রথমে তার মেয়ে ড. নায়লা হকের বাসায় ছিলেন। মেয়ে লন্ডনের কিংস কলেজে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করেন। ছেলে মো. আশিক উল হক সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। ফ্যাসিবাদ সরকারের সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তাকে সুপ্রিম কোর্টে তেমন একটা দেখা যায় না বলে দাবি করেন সহকর্মীরা। তিনিও গা-ঢাকা দিয়ে চলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খায়রুল হক এখন মেয়ের বাসায়ও নেই। তিনি লন্ডন ছেড়ে দূরবর্তী শহর ম্যানচেস্টারে অবস্থান করছেন।
খায়রুল হক হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে কর্মরত অবস্থায় দেশের বিচার বিভাগকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের তলানিতে নিয়ে যান। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করাই যেন ছিল তখন বিচার বিভাগের প্রধান দায়িত্ব। হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালীন স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করে একটি রায় দিয়েছিলেন। তার রায়ে বলা হয়েছিলÑ শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কাউকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হলে আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
শেখ হাসিনা দুজন সিনিয়র বিচারককে ডিঙিয়ে তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন তিনি। এরপরই তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। প্রধান বিচারপতির আসনে বসেই খায়রুল হক বিতর্কিত দুজনকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে শপথ পাঠ করান। ছয় মাসে শাহ খসরুজ্জামান ও রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ১০ জনকে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। শাহ খসরুজ্জামান সুপ্রিম কোর্টে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা এবং রুহুল কুদ্দুস বাবু একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন। যে মামলাটির কোয়াশিংয়ের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ হাইকোর্ট বিভাগও রায় দিয়ে বলেছিল মামলাটি নিম্ন আদালতে বিচারযোগ্য।
বিষয়টি নিয়ে তখনই আমার দেশ-এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে তাদের দুজনকে শপথ পাঠ করাতে অপরাগতা প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম। যদিও এই ফজলুল করিমও আওয়ামী লীগের অনুগত বিচারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তারপরও বাকি আটজনকে শপথ পাঠ করিয়ে দুজনের বিষয়ে অপরাগতা প্রকাশ করেন তিনি। এতে তাদের দুজনের বিচারকের আসনে বসা ঝুলে গিয়েছিল। নিয়োগের ছয় মাস পর ফজলুল করিম অবসরে যান। দুজনকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি হন খায়রুল হক। প্রধান বিচারপতির আসনে বসেই সিদ্ধান্ত দেন নিয়োগের পর ছয় মাস ঝুলে থাকা দুজনকে তিনি শপথ পাঠ করাবেন। তখন সুপ্রিম কোর্টের সাধারণ আইনজীবীদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হলেও খায়রুল হক পাত্তা দেননি। শাহ খসরুজ্জামান এবং রুহুল কুদ্দুস বাবু এখনো হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসেবে কর্মরত।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার দেওয়া অনেকগুলো বিতর্কিত রায়ের মধ্যে একটি হচ্ছে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া। খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মিলে একটি আগাম জামিনের আপিলের রায়ের মাধ্যমে এখতিয়ার কেড়ে নেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের।
তখন শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও ভিন্নমতের লোকদের ওপর নিপীড়ন আরো বেড়ে যায়। বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও ভিন্নমতের লোকজন হাইকোর্ট বিভাগে এসে যাতে আগাম জামিন নিতে না পারেন, সে লক্ষ্যেই ওই রায় দিয়েছিলেন খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তখনই হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ওই আদেশের পর থেকেই হাইকোর্ট বিভাগে কেউ আগাম জামিনের জন্য এলে তাকে নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইতে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের কারিগর ছিলেন খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। খায়রুল হকের নেতৃত্বে তাদের তিনজনের আপিল বিভাগের বেঞ্চেই শুনানি ছাড়া বাড়ি থেকে উচ্ছেদের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার আবেদনের শুনানি ছাড়াই তারা একতরফা রায় দিয়েছিলেন তখন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলেও এই তিনজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এমনকি আপিল বিভাগে সাত বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে প্রকাশ্যে দেওয়া রায়ের মূল অংশ ছিল পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। ওই অংশকে চূড়ান্ত রায়ে গায়েব করে দেন খায়রুল হক। তার সঙ্গে একমত হন মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ভোট ডাকাতির চূড়ান্ত সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন খায়রুল হকের নেতৃত্বে চার বিচারক।
বিচারব্যবস্থা ও গণতন্ত্র ধ্বংসের এই নাটের গুরু খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরের পরপরই আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করেন শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের আগে ২৮ জুলাই পর্যন্ত আইন কমিশনে অফিস করেন তিনি। ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে কমিশনে প্রায় নিয়মিত আসতেন বলে জানা গেছে। ২৮ জুলাই কমিশনের একটি বৈঠকও তিনি করেছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একটি সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে আলোচনার বিষয় ছিল ১৫ আগস্ট তাদের শোক দিবস পালনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করা। তবে ওই বৈঠকের পর আর তিনি কমিশনে আসেননি। ১৩ আগস্ট পদত্যাগ করে আড়ালে চলে যান। পদত্যাগের পর ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি দেশেই ছিলেন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিনি ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেন বলে জানিয়েছেন খায়রুল হকের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র।
খায়রুল হকের সব অপকর্মের মূল সহযোগী মোজাম্মেল হোসেন এখনো দেশেই আছেন বলে জানা গেছে। যদিও সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে শেখ হাসিনাই দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন।