
আপনি একটি নির্জন দ্বীপে আটকা পড়েছেন। চারদিকে অসীম জলরাশি, কোথাও কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই। হঠাৎ ঢেউয়ে ভেসে এলো একটি বোতল, আর তার ভেতর একটি চিঠি। ভাবুন তো, চিঠিটি হাতে নিয়ে আপনি কতটা উত্তেজনায় পড়তে শুরু করবেন?
ঠিক তেমনি আমাদের পৃথিবীও মহাবিশ্বের বিশাল সমুদ্রে একটি ছোট্ট দ্বীপ। আর মহাকাশের অজানার উদ্দেশ্যে পাঠানো ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড—একটি বোতলবন্দী বার্তা।
ভয়েজারের যাত্রা
১৯৭৭ সাল। নাসা শুরু করল মহাকাশ অন্বেষণের এক অসাধারণ মিশন: ভয়েজার ১ এবং ভয়েজার ২।
প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন — সৌরজগতের এই বৃহৎ গ্রহগুলোকে কাছ থেকে দেখা। কিন্তু এরপর ভয়েজারদের নিয়তি হলো সৌরজগত ছাড়িয়ে মহাবিশ্বের অজানার দিকে এগিয়ে চলা।
বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, যদি কোনো দূর গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণী কোনোদিন এই মহাকাশযান দুটিকে খুঁজে পায়, তারা নিশ্চয়ই জানতে চাইবে: "এগুলি কোথা থেকে এসেছে? কাদের বার্তা?" এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিল ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড।
গোল্ডেন রেকর্ডের রহস্য
বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান এবং তার দল এই রেকর্ডের নকশা করেন। এটি একটি স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া তামার ডিস্ক — দেখতে অনেকটা পুরোনো গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো। ১২ ইঞ্চি ব্যাসের এই ডিস্ক অ্যালুমিনিয়াম আবরণে সুরক্ষিত এবং মহাজাগতিক তেজস্ক্রিয়তা থেকে বাঁচাতে মোড়ানো হয় স্বর্ণের আস্তরণে।
স্বর্ণ কেন?
কারণ অক্সিজেনবিহীন মহাকাশের কঠিন পরিবেশেও স্বর্ণ দীর্ঘকাল অক্ষত থাকে। বিজ্ঞানীদের হিসেব, এই রেকর্ড প্রায় ১০০ কোটি বছর পর্যন্ত মহাকাশে টিকে থাকতে সক্ষম।
রেকর্ডে কী রাখা হবে—এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ, মাত্র একটি ডিস্কে আমাদের পুরো পৃথিবীকে তুলে ধরতে হবে!
অনেক আলোচনার পর এতে যুক্ত হয়:
১১৬টি ছবি: মানুষের শরীর, প্রাণীজগৎ, উদ্ভিদ, নদী, পাহাড়, শহর, গ্রাম, এমনকি ডিএনএ-র গঠন পর্যন্ত।
প্রাকৃতিক শব্দ: বাতাসের গর্জন, সমুদ্রের ঢেউ, পাখির গান, বজ্রপাত।
প্রযুক্তির শব্দ: ট্রেন, উড়োজাহাজ, কারখানার যন্ত্রপাতি।
সংগীত: বিথোভেন, মোৎসার্ট থেকে শুরু করে চীনা লোকসংগীত, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতসহ ৯০ মিনিটের সঙ্গীত।
শুভেচ্ছা বার্তা: বাংলাসহ ৫৫টি ভাষায়।
বাংলা ভাষায় বার্তাটি: "নমস্কার। বিশ্বে শান্তি হোক।"
কিন্তু প্রশ্ন হলো—ভিনগ্রহের প্রাণীরা কীভাবে বুঝবে এই রেকর্ড কী?
তাদের সাহায্য করতে, রেকর্ডের কভারে কিছু চিত্রাঙ্কিত নির্দেশনা রাখা হয়েছে— যেখানে মহাজাগতিক হাইড্রোজেন পরমাণুর সংকেত, রেকর্ড চালানোর পদ্ধতি ও গতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের আশা, বুদ্ধিমান প্রাণী মৌলিক গণিত ও পদার্থবিদ্যার মাধ্যমে এই সংকেত বুঝতে সক্ষম হবে।
ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড শুধু একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নয়। এটি ছিল মানবজাতির সাহস, কল্পনা আর ঐক্যের প্রতীক।
কার্ল সেগান বলেছিলেন: "এই রেকর্ড একটি মহাজাগতিক সমুদ্রে ভাসমান বোতলবন্দী বার্তার মতো। আমরা জানি না কেউ কখনো এটি খুঁজে পাবে কিনা। তবুও আমরা পাঠালাম আমাদের সবচেয়ে সুন্দর কিছু স্মৃতি।"
আজ ভয়েজার ১ সৌরজগত ছাড়িয়ে ইন্টারস্টেলার স্পেসে প্রবেশ করেছে — পৃথিবী থেকে ২৩ বিলিয়ন কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। ভয়েজার ২-ও একই পথে।
এরা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৬ থেকে ১৭ কিলোমিটার গতিতে মহাকাশের অজানার দিকে এগিয়ে চলেছে।
তবুও নিকটতম নক্ষত্রে পৌঁছাতে সময় লাগবে ৪০,০০০ বছর!
আমরা জানি — কারও পক্ষে হয়তো এই বার্তা কখনও পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও আমরা পাঠিয়েছি। কারণ মানবজাতি কখনো স্বপ্ন দেখতে ছাড়ে না।
হয়তো কোটি কোটি বছর পর, কোনো দূর গ্রহের প্রাণী যদি কখনো এই রেকর্ড খুঁজে পায়, তবে তারা জানতে পারবে — "কখনো, মহাবিশ্বের এক কোণায়, একটুখানি নীল গ্রহে, কৌতুহলী আর সৃষ্টিশীল প্রাণীরা বাস করত, যারা মহাবিশ্বে নিজেদের গল্প বলতে সাহস করেছিল।"
এবং সেই মুহূর্তে — আমাদের অস্তিত্বের এই ছোট্ট প্রমাণটুকু পৃথিবীর নাম অমর করে রাখবে মহাবিশ্বের ইতিহাসে।