
ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে হামলার পর থেকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিন্নমাত্রা তৈরি হয়েছে। দুই দেশই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এর কারণ উভয়ের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ। ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই হামলার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করেছে ভারত। জানিয়েছে কঠোর প্রতিক্রিয়া। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে করা সিন্ধু পানি চুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে ভারত। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। বলেছে, যদি সিন্ধু নদীর পানি বন্ধ হয় তাহলে প্রয়োজনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতেও পিছপা হবে না তারা। বিশ্লেষকরা একে যুদ্ধের ইঙ্গিত বলেই বর্ণনা করছেন।
এছাড়া আরেকটি বিষয় জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে, সেটি হলো- ভারত তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করলে ১৯৭২ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত শিমলা চুক্তি স্থগিত করতে পারে ইসলামাবাদ। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান যদি শিমলা চুক্তিকে টার্গেট করে তাহলে এর প্রভাব কেমন হবে- সে প্রশ্ন উঠছে এখন।
ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দু বলছে, শিমলা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের ২ জুলাই। এতে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো। যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয়ের মুখোমুখি হন এবং পাকিস্তানের বিভাজনের স্বাক্ষী হন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় শিমলা চুক্তির বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন তারা। যেটি মস্কোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে মূলত দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রথমত যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, যার মধ্যে ছিল ৯৩ হাজারের বেশি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির প্রত্যাবর্তন। দ্বিতীয়ত, জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের সমাধান। এতে উভয়পক্ষই একমত হয় যে, কাশ্মীর নিয়ে মতবিরোধ সমাধানে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা কিংবা পরস্পরের সম্মতিতে যেকোনো শান্তিপূর্ণ পদ্ধতির আশ্রয় নেবে তারা। এছাড়া এই শিমলা চুক্তির মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়
শিমলা চুক্তির জেরে ভারতে তীব্র সমালোচনা মুখোমুুখি হয়েছিলেন মিসেস গান্ধী। তখন কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি যুদ্ধবিরতির সীমারেখাকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। উভয় দেশ তখন ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) নামকরণে সম্মত হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানে ভুট্টোর তীব্র সমালোচনা হয়। বলা হয়, জাতিসংঘ বা অন্য কোনো তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সম্মত হয়েছিলেন তিনি। শ্রীনগরে শেখ আবদুল্লাহর সমালোচনার মূল কারণ ছিল, এই আলোচনায় কোনো পক্ষই কাশ্মীরি জনগণের মতামত নেননি।
পরবর্তী বছরগুলোতে পাকিস্তান এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে ভারত। দিল্লির অভিযোগ- কাশ্মীরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে এবং ১৯৯৯ সালের কারগিল সংঘাতের সময় নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে সেনা পাঠিয়েছে ইসলামাবাদ। এছাড়াও, পাকিস্তান জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের কাছে কাশ্মীর ইস্যুতে অভিযোগ জানিয়েছে, যা চুক্তিতে উভয় পক্ষের সম্মত শর্তাবলীর পরিপন্থী।
অন্যদিকে ১৯৯৪ সালে ভারতের সংসদ ঘোষণা দেয় যে, পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরসহ পুরো কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০১৯ সালে ভারত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করায়, শিমলা চুক্তিটি কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। ভারতের সাবেক কূটনীতিক অবতার সিং ভাসিন তার ‘নেগোশিয়েটিং ইন্ডিয়া’স ল্যান্ডমার্ক এগ্রিমেন্টস’ বইতে চুক্তিটির একটি বিশ্লেষণ করেছেন। তার দাবি শিমলা চুক্তি থেকে সরে যাওয়া কোনো দেশের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেছেন, শিমলা চুক্তি কোনো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হিসেবে প্রণয়ন করা হয়নি। মূলত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে নেয়া, বাণিজ্য, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ সংযোগ পুনরুদ্ধার করাই ছিল চুক্তিটির তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে কাশ্মীর সম্পর্কিত অনুচ্ছেদগুলো প্রতীকী ছিল বলে মনে করেন সাবেক ওই কূটনীতিক।
এটি লক্ষ্য করা উচিত যে, ২৪ এপ্রিল পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় (পিএমও) থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অধিকার ব্যবহার করবে পাকিস্তান। যার মধ্যে শিমলা চুক্তি অন্তর্ভুক্ত। যদিও এখনও স্পষ্ট নয় যে, ইসলামাবদ এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো বার্তা দিয়েছে কিনা। কেননা এ বিষয়ে ভারতকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়নি। তবে অনেকেই মনে করেন যে, শিমলা চুক্তির বিষয়টি জম্মু ও কাশ্মীর বিরোধের ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে। অবশ্য এ বিষয়টি নির্ভর করবে শিমলা চুক্তিতে উল্লেখিত কাশ্মীর নিয়ন্ত্রর রেখা এলওসি অতিক্রম করা থেকে পাকিস্তান নিজেদের বিরত রাখবে কিনা। বিশ্লেষকরা মনে করেন যদি পাকিস্তান এটি অতিক্রম করার চেষ্টা করে, তাহলে ভারতও হয়তো চুক্তি উপেক্ষা করবে এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে অপারেশন চালাবে। যাতে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পাকিস্তান অন্য কোনো চুক্তির নাম উল্লেখ না করলেও, শেহবাজ শরীফ সরকারের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির উল্লেখটি বিভিন্ন চুক্তির প্রতি ইঙ্গিত করতে পারে। যেগুলো দুই দেশ বছরের পর বছর ধরে মেনে চলছে। ১৯৪৮ সালের প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধ থেকে ১৯৯৯ সালের কারগিল পর্যন্ত একাধিক সশস্ত্র সংঘর্ষের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। যার মধ্যে একটি হচ্ছে ১৯৫০ সালে স্বাক্ষরিত নেহরু-লিয়াকত চুক্তি। উভয় দেশের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন তারা। এছাড়া ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক প্রটোকল রিলিজিয়াস পিলগ্রিমেজ সংক্রান্ত চুক্তি পাকিস্তানের ১৫টি মন্দির এবং গুরুদ্বারে হিন্দু ও শিখ তীর্থযাত্রীদের যাত্রা সহজতর করার পাশাপাশি ভারতেও মুসলিমদের পাঁচটি মসজিদ ও মাজারে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে, উভয় পক্ষই ইঙ্গিত দিয়েছে যে, ২০১৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ইমরান খান সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত কার্তাপুর করিডর চুক্তিও প্রভাবিত হতে পারে।
দুই দেশের মধ্যে আরও যেসকল চুক্তি হয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেগুলোও প্রভাবিত হতে পারে। ১৯৮৮ সালে পারমাণবিক বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত ও পাকিস্তান। এর মাধ্যমে প্রতিবছরের ১লা জানুয়ারি উভয় দেশই নিজ নিজ পারমাণবিক স্থাপনা সম্পর্কে অন্য পক্ষকে অবহিত করে।
১৯৯১ সালে দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়, তাতে সব ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার বিষয়ে আগাম সচেতনতা দিতে বাধ্য করে। এছাড়া ওই চুক্তির মাধ্যমে আকাশসীমা লঙ্ঘন না করতেও উভয় দেশ সম্মত হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত ও পাকিস্তান একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়ন করেছে, যা ২০০৩ সালে প্রথম স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের যেসব স্থানকে টার্গেট করে ভারত সামরিক অভিযান পরিচালনার হুমকি দিয়েছে তা যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে এই যুদ্ধবিরতির চুক্তিটি ভেঙে যেতে পারে। এছাড়া, ভারত যদি সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে তাহলে এর পরবর্তী প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। কারণ পাকিস্তান হুমকি দিয়েছে, তারা ভারতকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাবে এবং পানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ‘যুদ্ধের উস্কানি’ বলে বিবেচিত হবে। মোটাদাগে সিন্ধু পানি চুক্তি ভারত ও পাকিস্তান ইস্যু হলেও এর প্রভাব বাংলাদেশ ও চীনেও পড়বে। তাই এই দেশগুলোও এ বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।