
গ্রামাঞ্চলের রোগীরা সাধারণ জ্বর থেকে শুরু করে তুলনামূলক কম জটিল রোগের চিকিৎসায় কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা হাসপাতালের শরণাপন্ন হন। কিন্তু শহরাঞ্চলে বাস করা রোগীদের ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা নেই।
ফলে সরাসরি সেকেন্ডারি হাসপাতাল তথা জেলা সদর হাসপাতাল কিংবা টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে ছুটতে হয় তাদের। এতে ২০ টাকার চিকিৎসা নিতে গিয়ে হাজার টাকা চলে যায়। পাশাপাশি সক্ষমতার তুলনায় রোগী বেশি হওয়ায় মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দিতে ব্যর্থ হন চিকিৎসকরা।
এ সমস্যার সমাধানে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরে ৭ কোটি মানুষের জন্য আরবান প্রাইমারি হেলথকেয়ার বা নগরকেন্দ্রিক প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর নাম হবে ‘জেনারেল প্র্যাক্টিশনার (জিপি) ক্লিনিক’।
সূত্র জানায়, সাধারণ সমস্যায় প্রাথমিক পরামর্শের জন্য কোথায় যাবেন, কোন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেবেন, কতটুকু অসুস্থ হলে কোন পর্যায়ের হাসপাতাল কিংবা বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেনÑ এ-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নেই শহরাঞ্চলের রোগীদের। ফলে বেশিরভাগ সময়ই রোগীরা সংশয়ে থাকেন, ভুল করে অন্য রোগের বিশেষজ্ঞের কাছে চলে যান। এ অবস্থার উত্তরণে শহরাঞ্চলে চিকিৎসাক্ষেত্রে স্ট্রাকচারাল রেফারেল পদ্ধতিতে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চালু হচ্ছে এই ‘জিপি ক্লিনিক’।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও শহরাঞ্চলের মানুষের সাধারণ চিকিৎসায় নজর দেয়নি। অথচ মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ কোটি শহরে বাস করেন। ২০২২ সালে ঢাকার দুই সিটিতে কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর পরিকল্পনা নিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। নতুন এই পদক্ষেপ শহরাঞ্চলের মানুষের চিকিৎসাসেবায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। এতে করে শহরমুখী রোগীর চাপ কমে আসবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটি ঐতিহাসিক একটি পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে। এতে করে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। চাহিদা অনুযায়ী মিলবে চিকিৎসাসেবা। তবে বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশের শহরে জিপি ক্লিনিক চালুর চিন্তা থাকলেও প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহরে ২৬টি স্থাপন করতে চায় সরকার। পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় ও জেলা শহরে চালু হবে। মূল লক্ষ্য সেকেন্ডারি, টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীর চাপ কমানো। তবে সবগুলো চালু করতে পারবে না অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের কাছে সুপারিশও করে যাবে নূরজাহান বেগমের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, এসব ক্লিনিকে ক্লিনিক্যাল ফিজিশিয়ান (চিকিৎসক) ছাড়াও থাকবে সাধারণ কিছু রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা (ল্যাবরেটরি) ও ফার্মাসিউটিক্যাল সেবা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় শহরাঞ্চলের মানুষের প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখানে সাধারণ ও জটিল রোগী একত্রে ভিড় করছেন বড় হাসপাতালে। কেউই ঠিকঠাক চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
অথচ এসব রোগীর অর্ধেকই হাসপাতালে আসার কথা নয়। সেকেন্ডারি, টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালে আসবেন কেবল ভর্তিযোগ্য রোগীরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। এ কারণেই আরবান প্রাইমারি হেলথকেয়ারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। রোগীদের নিজে থেকে সরাসরি টারশিয়ারি হাসপাতালে যাওয়ার প্রবণতা আমরা কমাতে চাই।’
জিপি ক্লিনিকের বিষয়ে আরো জানা গেছে, দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকবে একটি ক্লিনিক। চিকিৎসা, ওষুধ ও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকবে। এটা কোনো জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্র হবে না। রোগীর ভর্তি প্রয়োজন আছে কি না, কোন বিভাগে ও কোন বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে, তাও এই ক্লিনিকের চিকিৎসকরা নির্ধারণ করবেন। উন্নত বিশ্বেও এই নিয়ম চলে আসছে।
কবে নাগাদ এই ক্লিনিক চালু হতে পারেÑ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘সবকিছু পরিকল্পনামাফিক করতে গেলেও অন্তত ছয় মাস লাগে। তারপরও আমরা যত দ্রুত পারি চালু করার চেষ্টা করব। তবে শুরুতে ঢাকা মহানগর দিয়ে করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে। আমাদের হাতে সময় কম, তাই যতটা পারি করব, বাকিগুলো পরে যারা আসবেন, তাদের দায়িত্ব থাকবে।’
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম আমার দেশকে বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে দুর্বলতা ছিল নগরকেন্দ্রিক প্রাথমিক চিকিৎসা চালু করতে না পারা। আরেকটি জটিলতা হলো, এখানকার স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় সরকারের হাতে। এ দুটি দুর্বলতা দূর করতে এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো।
বিএমইউ, জাতীয় কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মতো টারশিয়ারি এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ রোগী আসেন, যার বড় অংশেরই এ পর্যন্ত আসার প্রয়োজন নেই। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা পাওয়ার কথা। আবার যাদের আসা প্রয়োজন, হাসপাতালে বিপুল পরিমাণ রোগীর কারণে তারা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হন। এ জন্য রেফারেল সিস্টেম এবং প্রয়োজন অনুযায়ী স্তরভিত্তিক চিকিৎসার উদ্যোগ যথার্থ। এতে করে রোগী সন্তুষ্ট হওয়ার পাশাপাশি দূরবর্তী জায়গায় যাওয়ার ভোগান্তি কমবে, যাতায়াত খরচও সাশ্রয় হবে।’
তবে এটাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখার পরামর্শ এই অধ্যাপকের। বিএমইউ উপাচার্য বলেন, ‘স্থানীয় সরকার এখানে একটা বড় ফ্যাক্ট। কিন্তু সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই এটাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখতে হবে।’
তবে উদ্যোগ গ্রহণের বেশ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো চালু না হওয়ার পেছনে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘মূলত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এসব ক্লিনিক করার কথা ছিল। কিন্তু তারা সরে যাওয়ায় অর্থসংকটে এখনো কিছুই এগোতে পারেনি। এ ছাড়া স্থানীয় সরকারের সঙ্গেও জটিলতা রয়েছে।
জায়গা নির্ধারণ, ভবন নির্মাণ ও চিকিৎসক নিয়োগসহ বেশকিছু জটিলতা রয়েছে। এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার। পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি স্থানীয় সরকারের আওতায় থাকবে, তা নিয়েও আলোচনা করতে হবে।’
জানতে চাইলে সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুস সবুর খান বলেন, ‘পরিকল্পনা ভালো। কিন্তু পাঁচ মাস আগে এই উদ্যোগের কথা শুনলেও এখন পর্যন্ত একটিও চালু করতে পারেনি, পারবে বলেও মনে হয় না। কারণ, তারা প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ক্লিনিক বানাতে চাচ্ছে। কিন্তু টাকা পাবে কোথায়? জমি, ভবন লাগবে। যন্ত্রপাতির কথা বাদই দিলাম। চিকিৎসকসহ অন্যান্য জনবল যে কাজ করবে, তাদের বেতন কোথা থেকে আসবে? সরকারের এত টাকা নেই। তারা বিশ্বব্যাংকের ভরসায় ছিল। কিন্তু তারা সরে যাওয়াতেই মূলত সমস্যাটা হয়েছে। তাই যত সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবায়ন ততটা সহজ নয়।’