
সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে প্রয়োজনীয় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীসহ প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মজুত শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। এতে প্রান্তিক এলাকার মানুষের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে এবং বাড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্যে খাবার বড়ি (তৃতীয় প্রজন্ম) খুবই জনপ্রিয়, যা প্রায় ৪০ শতাংশ সক্ষম দম্পতি ব্যবহার করেন। তবে দেশের অর্ধেকের বেশি উপজেলায় কনডম, খাবার বড়ি, আয়রন ট্যাবলেট এবং স্বাভাবিক সন্তান জন্মদান কিটসহ মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিভিন্ন সামগ্রীর মজুত শূন্যের কাছাকাছি। ফলে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী জরুরি এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি ও উপকরণ বিতরণের জন্য প্রতি ইউনিয়নে একজন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ও তিনজন পরিবারকল্যাণ সহকারী দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সপ্তাহে চার দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে দম্পতিদের সঙ্গে আলোচনা ও সামগ্রী বিতরণের কথা থাকলেও উপকরণ ঘাটতির কারণে অনেকেই নিয়মিত যাচ্ছেন না। যারা যাচ্ছেন, তারাও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ বা মজুত না আসা পর্যন্ত বাজার থেকে কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাপ্লাই চেইনের সর্বশেষ (২৪ এপ্রিল পর্যন্ত) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৯ থেকে ১০ লাখের বেশি সাইকেল খাবার বড়ির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৩২৪টি উপজেলা স্টোরে খাবার বড়ির মজুত শূন্য এবং আরও ১০৩টি স্টোরে যে কোনো সময় শূন্য হয়ে যেতে পারে। ৩৩টি উপজেলায় মজুত সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের খাবার বড়ির মজুত পরিস্থিতি আরও খারাপ, ৪৮৩টি উপজেলায় মজুত একেবারে নেই এবং ৮টি উপজেলায় যে কোনো সময় শেষ হয়ে যাবে। মাঠ পর্যায়ে ৩১৩টি উপজেলায় এই বড়ির মজুত নেই এবং আরও ৭৪টি উপজেলায় মজুদ যে কোনো সময়ে শেষ হয়ে যাবে। আপন বড়ির মজুত নেই ২০৫টি উপজেলায়, মজুত শেষের পথে আরও ১৪৭টি উপজেলায় এবং সর্বনিম্ন মজুত রয়েছে ৭০টি উপজেলা স্টোরে।
মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে তৈরি ডিডিএস কিটেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ৪৩০টি উপজেলা স্টোরে এই কিট নেই, ৪৬টিতে শেষ পর্যায়ে এবং ১৩টিতে সর্বনিম্ন মজুত রয়েছে।
পুরুষদের মধ্যে বহুল ব্যবহৃত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কনডমের সরবরাহ নেই শতাধিক উপজেলা স্টোরে। ১৬৮টি উপজেলা স্টোরে মজুত শেষ, ১৪৬টিতে শেষ পর্যায়ে এবং ৮৮টিতে মজুত আছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে তৈরি প্যাকেজ ডিডিএস কিট-এর সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। দেশের ৪৫৭টি উপজেলা স্টোরে কোনো ডিডিএস কিট নেই। ৩০টি উপজেলার স্টোরে এই কিট শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আরও ৬টি উপজেলা স্টোরে কিটের মজুত সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে।
স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় ডেলিভারি কিটের মজুত ৪৯৪টি উপজেলা স্টোরে শেষ। মাঠ পর্যায়েও এর কোনো সরবরাহ নেই। গর্ভকালীন সময়ের আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট এবং বাহ্যিক ক্ষতস্থানের জীবাণুনাশক প্রোভিডিনেরও সরবরাহ ও মজুত নেই।
কৈশোরবান্ধব কর্নারের মাধ্যমে প্রজনন সম্পর্কিত যে সেবা দেওয়া হয়, সেখানেও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সরকার পরিবার পরিকল্পনা সেবা সহজীকরণ এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পর্যায়ে দক্ষ ধাত্রী ও মিডওয়াইফ নিয়োগ দিয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ১০ শয্যাবিশিষ্ট ১৫৯টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন এবং সেবাদানের জন্য ১ হাজার ৫৯০টি পদ তৈরি করা হয়েছে। জেলা শহরে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রকে হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে। কৈশোরকালীন জন্মহার কমাতে ২০১৭-৩০ মেয়াদের জন্য জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্য কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গর্ভধারণ থেকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত মা ও শিশুর সুস্থতায় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর বিকল্প নেই। এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে দেশে মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমছে। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার কারণে কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও স্বাস্থ্য বিভাগ তা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় দরপত্র বাতিল হয়। এরপর থেকেই সংকট শুরু হয়। তবে এই সংকট নিরসনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তেমন তৎপরতা নেই। মাঠকর্মীদের কাছে কনডম, খাবার বড়ি বা অন্যান্য সামগ্রীর মজুত প্রায় শূন্য। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিতরণ ব্যাহত হলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মোট প্রজনন হার (টিএফআর) বৃদ্ধি পাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, দেশের একটি শ্রেণির মানুষ পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর জন্য সরকারের ওপর নির্ভরশীল। মজুত সংকটের কারণে এই জনগোষ্ঠী বিপাকে পড়েছে। আয়রন ট্যাবলেট প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অধিকাংশ নারীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম। দরিদ্র ও অল্প বয়সে মা হওয়া নারীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা বেশি। আয়রন ট্যাবলেটের সরবরাহ না থাকলে তাদের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আরও কমতে পারে, যা গর্ভবতী মা ও সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলবে।
তিনি আরও বলেন, কনডম ও খাবার বড়ির সংকটে পরিকল্পিত পরিবার পরিকল্পনায় প্রভাব পড়বে। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বাড়লে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়বে, যা নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে এবং এটি মাতৃমৃত্যুর কারণও হতে পারে। এই সংকট অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল কালবেলাকে বলেন, গর্ভকালীন সময়ে আয়রনের অভাবে নারীদের রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর এই আয়রন ট্যাবলেট কিনে খাওয়ার সক্ষমতা নেই। কাজেই এই জনগোষ্ঠীকে সরকার বিনামূল্যে দিয়ে থাকে, যা সরবরাহ করা না গেলে গর্ভবতী মায়ের রক্তস্বল্পতা বাড়বে এবং গর্ভের সন্তানের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। মায়ের রক্তস্বল্পতা থাকলে প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে এবং এটি মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ।
তিনি আরও বলেন, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সরকার বিনামূল্যে সরবরাহ করায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। সরবরাহ বন্ধ হলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের হার বাড়বে, যা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কনডম শুধু গর্ভধারণ রোধই করে না, যৌনবাহিত রোগও প্রতিরোধ করে। আবার কাউকে হয়তো অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য চিকিৎসক মুখে খাওয়ার বড়ি খেতে নিষেধ করেছেন। তিনি তাহলে এই পরিস্থিতিতে কী করবেন? যার জন্য যেটা প্রয়োজন তাকে সেটাই দিতে হবে। একটার বিকল্প আরেকটাকে করা যাবে না।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপকরণ ও সরবরাহ বিভাগের পরিচালক মার্জিয়া হক সংকটের কথা স্বীকার করে কালবেলাকে বলেন, সব উপকরণের সংকট তৈরি হয়েছে। তবে সংকট মোকাবিলায় চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব উপকরণ সামগ্রীর সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পরিবার পরিকল্পনার উপকরণ কেনাকাটা হয়নি, দরপত্র বাতিল হয়েছিল। কেনাকাটার জটিলতা নিয়ে মামলা-মোকাদ্দমাও হয়েছিল। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মহোদয় রাজস্ব খাত থেকে অর্থ ছাড়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন। মোটকথা আমাদের চেষ্টা আছে; কিন্তু টাকার উৎস না থাকলে তো আমরা কিনতে পারব না। আশা করছি, দ্রুত এই সংকট কেটে যাবে।