
৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়া ২২৭ প্রার্থীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বারবার ধরনা দিয়েও চাকরিতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তারা। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন না বলে অভিযোগ তুলেছেন বাদ পড়া প্রার্থীরা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিও তুলেছেন তারা।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক কালবেলাকে বলেন, বাদ পড়া প্রার্থীদের নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কবে নাগাদ প্রজ্ঞাপন জারি হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি তিনি।
বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব মো. সাইফুল্লাহ পান্নাকে একাধিকবার ফোন করেও তাদের সাড়া মেলেনি।
বাদ পড়া একাধিক প্রার্থী কালবেলাকে বলেন, আমরা বিসিএস যোগদান করব—এমন চিন্তা থেকে অন্য চাকরিতে যোগ দিইনি। অনেকে আগের চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন; কিন্তু ভেরিফিকেশনের নামে আমাদের নিয়োগ আটকে রাখা হয়েছে। অথচ আমরা সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম না। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা হতাশার মধ্যে আছি। আমাদের পরিবারের সদস্যরাও হতাশ। বৈষম্যহীন বাংলাদেশে এমনটি হবে, আমরা আশা করিনি। দ্রুততম সময়ে আমাদের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির জন্য প্রধান উপদেষ্টাসহ সবার প্রতি অনুরোধ জানাই।
এভাবে এতসংখ্যক উত্তীর্ণ প্রার্থীর নিয়োগ আটকে রাখার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক, তা জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালবেলাকে বলেন, নিয়োগের সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কে ছাত্রলীগ, কে ছাত্রদল কিংবা কে শিবির, তা বিবেচনা করা রাষ্ট্রীয় বৈষম্য। এই বৈষম্য থেকে রাষ্ট্রকে বের হতে হবে। সবাইকে চাকরির সুযোগ দিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার অংশে ২৯ অনুচ্ছেদের (১)-এ স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে—প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। বাদ পড়া এসব প্রার্থী রাষ্ট্রের নাগরিক। অথচ মেধার পরীক্ষায় তিন ধাপ পেরিয়েও শুধুমাত্র ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ তাদের আটকে দিয়েছে সরকার। এটি সংবিধান লঙ্ঘন হিসেবেই দেখছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, বৈষম্য নিরসনের জন্য বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু আমরা এখনো বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি। মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের যোগদান করতে দেওয়া হতো না। বর্তমান সরকারও যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ না দেয় এটা নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর। চাকরি পাওয়া নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে আটকে দেওয়া প্রার্থীরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে চাকরি পেয়েছেন। এখন যারা আটকে পড়েছেন তারাও এক সময় আদালতে যাবেন। তারপর চাকরি পাবেন এবং বকেয়া বেতন-ভাতাও পাবেন। সুতরাং তাদের বসিয়ে রেখে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হবে। কারণ চাকরি তারা পাবেনই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, বাদ পড়া ২২৭ প্রার্থীর মধ্যে ১৯৫ জনের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। অথচ এই ১৯৫ জনের বেশিরভাগের নামেই আপত্তি আসেনি আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে। আবার দ্বিতীয় গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রতিবেদনে বিরূপ মন্তব্য এসেছে ৭৭ জনের নামে। অর্থাৎ ভেরিফিকেশন করতে গিয়ে অনেক প্রার্থীর বিষয়ে দুই গোয়েন্দা সংস্থা একমত হতে পারেনি। তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সংস্থাগুলোর এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই প্রার্থীদের নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। পরে বাদ পড়া প্রার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে ফের ভেরিফিকেশন করা হয়। ভেরিফিকেশন শেষে তাদের প্রজ্ঞাপন জারির কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন গবেষক ও বিশ্লেষক মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া কালবেলাকে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্থানীয় লোকজন কিংবা জনপ্রতিনিধিদের মুখের কথা শুনে চাকরিপ্রার্থীদের নামে প্রতিবেদন দেয়। এমন পদ্ধতিতে ভেরিফিকেশন করা হলে সঠিক তথ্য আসে না। এতে প্রার্থীদের নামে বিরূপ মন্তব্য আসতে পারে। কারণ, এলাকায় তার সঙ্গে জনপ্রতিনিধি কিংবা স্থানীয় লোকজনের সম্পর্ক ভালো নাও থাকতে পারে। ভেরিফিকেশন হওয়া উচিত দালিলিক তথ্যপ্রমাণসহ। কোনো ধরনের দালিলিক প্রমাণ ছাড়া কারও মুখের কথায় রিপোর্ট দেওয়া হলে একজন প্রার্থীর নামে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য মিলবে। একজন প্রার্থীর বিষয়ে একেক সংস্থা একেক রিপোর্ট দেবে। সুতরাং দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করে রিপোর্ট দিতে হবে।
এদিকে একটি সূত্রের ভাষ্য, বাদ পড়া ২২৭ জনের মধ্যে ১৭১ জনকে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন পাওয়ার পর তাদের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। তবে বিষয়টি স্বীকার করেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা। তারা বলছেন, ২২৭ জনের মধ্যে খুব বেশি প্রার্থী বাদ পড়বেন না। দুইশর বেশি প্রার্থীই নিয়োগ পাবেন। যাদের নামে ফৌজদারি মামলা নেই তারা নিয়োগ পাবেন। আর ফৌজদারি মামলা থাকলে নিয়োগ হবে না।
গত বছরের ১৫ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরে ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে ৩০ ডিসেম্বর আবার প্রজ্ঞাপন জারি হয়। ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২ হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেছিল সরকারি কর্ম কমিশন।