
দেশে অ্যানোফিলিস মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর ৯২ শতাংশই তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দা। জেলাগুলো হলো-বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি। আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সর্বাধিক হওয়ায় জেলাগুলোকে উচ্চ ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চল হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলার ৭৭টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব এখনো বেশি। এমন বাস্তবতায় সারা বিশ্বের মতো আজ বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস-২০২৫’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-‘আমরাই করব ম্যালেরিয়া নির্মূল : নব উদ্যমে, নব বিনিয়োগে ও নব চিন্তায়।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ক্রস বর্ডার তথা সীমান্ত অতিক্রম করে অনেকে ভারত ও মিয়ানমারে চলাচল করছে। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম সারোয়ার যুগান্তরকে বলেন, অ্যানোফিলিস মশা আর্দ্রতা মিশ্রিত ছায়াযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকে। অর্থাৎ ঝোপঝাড় ও পাহাড়ি এলাকায় এদের প্রাচুর্যতা লক্ষণীয়। এরা মানুষ ও গবাদি পশুর রক্ত বেশি পছন্দ করে। পূর্ণাঙ্গ মশা দল বেঁধে উড়ে বেড়ায়। এ মশা ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী প্লাজমোডিয়াম নামক প্রোটোকটিস্ট জীবাণুর বাহক হিসাবে কাজ করে।
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কমিউনিক্যাবল ডিজিজ কন্ট্রোল শাখা স্বীকার করছে ম্যালেরিয়া নির্মূলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-সীমান্তবর্তী দেশগুলোয় চলাচল/পারাপারকারীর মধ্যে ইমপোর্টেড ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।
২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ২০২৬ সালে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণার পরিকল্পনা চলছে। ২০২৭ সালের মধ্যে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে ম্যালেরিয়া রোগীপ্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ১-এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালে বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ নিয়ে আবেদন করবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কাছে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০৩৩ সালে ডব্লিউএইচওর ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণার অপেক্ষায় বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ্যামল কুমার দাস যুগান্তরকে বলেন, চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের প্রাদেশিক পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক চলমান রয়েছে। আন্তঃসীমান্ত চলাচলকারীদের যথাসম্ভব চিহ্নিত করে তাদের ম্যালেরিয়া বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর (জুম চাষি, কাঠুরিয়া, কয়লা শ্রমিক, রোহিঙ্গা শরণার্থী ইত্যাদি) তথ্য সংগ্রহ করে কর্মসূচির আওতায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী কীটনাশকযুক্ত মশারি ক্যাম্পে বিতরণ করা হয়েছে। সচেতন করা হচ্ছে। ম্যালেরিয়া সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে।
জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুহ্রাসের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ম্যালেরিয়াজনিত অসুস্থতা ৮৫ ভাগ এবং মৃত্যু ৯৬ ভাগ কমেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে মোট ম্যালেরিয়া রোগী ছিল ১৩ হাজার ৯৯ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন। ২০২৩ সালে শনাক্ত হয়েছিল ১৬ হাজার ৫৬৭ জন এবং মারা যান ৬ জন। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির পক্ষ থেকে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৬ মিলিয়নের বেশি দীর্ঘমেয়াদি কীটনাশকযুক্ত মশারি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।