Image description

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুরের ছোট এক গ্রামে গত ১৭ এপ্রিল হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় মারা যান। তার এই মৃত্যুকে তখন ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে’ মৃত্যু বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

ভবেশের মৃত্যুর এই ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে ‘অপহরণ ও  পিটিয়ে হত্যার’ ঘটনা হিসেবে ছাপা হয়। ডেইলি স্টারের ওই প্রতিবেদনটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারা ঘটনাটিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদচ্যুতির পর বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বলে সমালোচনার হাতিয়ার হিসেবে নেয়। আর প্রচারকৃত এই বয়ান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি ‘নীপিড়ক’ হিসেবে তুলে ধরছে। 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং এই ঘটনাকে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের বৃহৎ পরিসরে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর ‘পদ্ধতিগত নির্যাতনের’ অংশ বলে অভিহিত করেছে।  

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু নেতা শ্রী ভবেশ চন্দ্র রায়ের অপহরণ ও  নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি দেখেছি। 

ডেইলি স্টারের প্রাথমিক ওই প্রতিবেদনের বরাতে ভারতীয় শীর্ষ পত্রিকাগুলো এই নিউজকে তাদের প্রথম পাতায় ছেপেছে। আর টিভিগুলো এই ঘটনাকে প্রাইম-টাইম কভার দিয়েছে। আর বেশ কয়েকটি টক শোতে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের নিন্দা জানিয়ে উত্তপ্ত প্যানেল আলোচনা হয়েছে। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে এই ক্ষোভ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত এক্সে, যেখানে হিন্দুত্ববাদী সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টগুলো বিশেষভাব সোচ্চার ছিল। এমনকি সদগুরুর মতো আধ্যাত্মিক নেতাও ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এই নিয়ে টুইটে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‍এই বর্বর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এটি উপমহাদেশ এবং মানবতার উপর একটি কলঙ্ক। অগ্রহণযোগ্য।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের সাম্প্রতিক এক বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের এই প্রতিক্রিয়া এসেছে। ওয়াকফ আইন নিয়ে মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের ভিত্তিহীন অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে শফিকুল আলম বলেছিলেন, ভারতের উচিত তার নিজ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত করায় মনোনিবেশ করা।

এদিকে, প্রাথমিকভাবে এই ক্ষোভ সত্ত্বেও ডেইলি স্টার যে তার ওয়েবসাইট থেকে মূল প্রতিবেদনটি সরিয়েছে তা সামনে এসেছে। পত্রিকাটি এই ঘটনার তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাইয়ের জন্য ঢাকা থেকে একজন প্রতিবেদককে পাঠিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমটির অন্তত দুটি সূত্রে জানা গেছে,‘প্রমাণিত নয় এমন দাবির’ উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ায় স্থানীয় সংবাদদাতা কংকন কর্মকারের চুক্তি বাতিল করেছে ডেইলি স্টার। 

দিনাজপুরে আসলেই কী ঘটেছিল?

৫৫ বছর বয়সী ভবেশ চন্দ্র বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের বিরল ইউনিটের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৪৭ বছর বয়সী এই সংগঠনটির সারা দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে শাখা রয়েছে। সংগঠনটি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব আয়োজন করে থাকে। 

এদিকে, বাসুদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা ভবেশ পেশায় একজন কৃষক ছিলেন। তার স্ত্রী শান্তনা রানী রায়ের মতে, সম্প্রতি তিনি (ভবেশ) আর্থিক সংকটে পড়েন এবং স্থানীয় দুই মহাজন—আতিকুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ রতন ইসলামের কাছ থেকে ঋণ নেন। 

ভবেশের ২৮ বছর বয়সী ছেলে স্বপন চন্দ্র রায় বাবার এই মৃত্যুর ঘটনায় বিরল থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, তার বাবা আতিকুল এবং রতনের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন।

দায়েরকৃত এজাহার অনুসারে, গত ১৭ এপ্রিল ওই দুজনই ভবেশের বাড়িতে এসে তাকে বিকাল ৪টা ৩০মিনিট নাগাদ কাছের একটি বাজারে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই ভবেশের মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। আনুমানিক রাত ৮টার দিকে রতনের কাছ থেকে স্বপন ফোন পান। ফোনে রতন জানান, ভবেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং স্বপনকে দ্রুত যেতে বলেন।

স্বপন ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে ছিলেন। তাই তার বাবাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য রতনকে অনুরোধ করেন। তবে অভিযোগ অনুসারে, তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে রতন এবং অন্যরা ভবেশকে ফুলবাড়ি বাজারের কাছে রেখে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়েন। 

পরিবারের সদস্যরা যখন উদ্ধার করেন তখন ভবেশ অচেতন অবস্থায় ছিলেন। তাকে দ্রুত দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মামলার তদন্তের নেতৃত্ব দেওয়া বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সবুর বাংলা আউটলুককে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ভবেশের মৃত্যু ‘অস্বাভাবিক’ বলে মনে হচ্ছে। তবে তিনি এও বলেছেন, তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই।

সবুর বলেন, ‘সম্ভবত হার্ট অ্যাটাকের কারণে এমনটা হয়েছে। ময়নাতদন্ত চলছে। প্রতিবেদন পেলেই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। এই ধরনের শত শত ঘটনা দেখভালের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ভবেশের শরীরে শারীরিকভাবে আক্রমণের কোনো চিহ্ন ছিল না।’

দিনাজপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফাত হোসেনের ধারণাও প্রায় একই। তিনি বাংলা আউটলুককে বলেন, ‘তদন্তের জন্য একাধিক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে হার্ট অ্যাটাকের ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে।’

পুলিশের শনাক্ত করা দুই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তারা ভবেশকে সেই সন্ধ্যায় আতিকুল এবং রতনের সঙ্গে রাস্তার পাশের একটি দোকানে ভাজাপোড়া খেতে দেখেছেন। তাকে ধূমপান করতে এবং জর্দার সঙ্গে পান মিশিয়ে চিবিয়ে খেতেও দেখেছেন বলে জানান তারা।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে একটি সূত্র জানিয়েছে, সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের সময় ভবেশ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ‘তিনি পড়ে যান। তখন তারা তার পালস পাননি।’

বিরল উপজেলার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক আহমেদের সঙ্গেও কথা বলেছে বাংলা আউটলুক। ঘটনার পর পরই তিনি ভবেশের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা চূড়ান্ত কোনো বক্তব্য দিতে পারছি না। তবে মরদেহে দৃশ্যমান কোনো আঘাত বা আক্রমণের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।’

ইশতিয়াক উল্লেখ করেছেন, যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা রোধে এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভবেশের পরিবারকে পূর্ণ সহায়তা এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছি।’

এদিকে, অভিযোগ দায়েরকারী ভবেশের ছেলে স্বপন চন্দ্র বাংলা আউটলুককে বলেছেন, ‘তার বাবার মৃত্যু স্পষ্টতই “স্বাভাবিক নয়”’। 

তিনি বলেন, ‘তিনি সুস্থ অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। বের হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর আমাদের জানানো হয় তিনি মারা গেছেন। এর কোনো মানে হয় না।’

পুলিশের পর্যবেক্ষণে শরীরের আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না বলে স্বীকার করে স্বপন আরও বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি এটা জানি। কিন্তু এজাহারে আমি যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের তীব্র মানসিক চাপ তার মৃত্যুর পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে।’

ভবেশের মৃত্যুর খবর বিকৃত করা হয়েছিল কেন?

এদিকে, ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক কংকন কর্মকারের লেখা প্রাথমিক প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছিল, ভবেশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলি দ্রুত এই প্রতিবেদনটি লুফে নেয় এবং ব্যাপক প্রচার করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায়।

বাংলাদেশও দৃঢ়ভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ভারতের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

ভারতের প্রতিক্রিয়ার জবাবে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক বিবৃতিতে শফিকুল আলম বলেন, ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে ভবেশের মৃত্যুকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর ‘পরিকল্পিত নির্যাতনের নমুনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা এই ভিত্তিহীন দাবি প্রত্যাখ্যান করছি।’

সাংবাদিকসহ স্থানীয় একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলা আউটলুক। তাদের ধারণা, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে ভবেশের মৃত্যুর খবরটি ‘আন্তর্জাতিক ইস্যুতে’ পরিণত করা হয়েছিল।

তাদের মতে, আতিকুল এবং রতন—উভয়ে স্থানীয় রাজনীতি করেন। এলাকায় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে যারা ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করে পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল। তাই তাদের উপর চাপ তৈরি করা হয়েছিল।

সূত্রগুলি নিশ্চিত করেছে, আতিকুল এবং রতন ভবেশের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। আর সেই চাপই তার স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ হয়ে থাকতে পারে।

তবে, ভবেশের আকস্মিক মৃত্যুতে তাদের বিরোধীরা তাদেরকে বিপাকে ফেলার সুযোগ পেয়েছিল এবং এই বয়ানকে আরও জোরালো করে সামনে এনেছিল যে, এটি একটি সাম্প্রদায়িক আক্রমণ।

ধারণা করা হচ্ছে, ঘটনার ওই সংস্করণটি স্বার্থান্বেষী সূত্রগুলিই কংকন কর্মকারকে দিয়েছিল যা তার ওই প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিবেদনের ভিত্তি তৈরি করেছিল।

এই ব্যাপারে বক্তব্যের জন্য কংকন কর্মকারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করে বাংলা আউটলুক। তবে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ডেইলি স্টারও এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।