
জনসংখ্যা ও আয়তনের ভিত্তিতে দেশের বিদ্যমান ইউনিয়ন পরিষদগুলোর ওয়ার্ডের সংখ্যা পুনর্নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ডের সংখ্যা সর্বনিম্ন ৯টি থেকে সর্বোচ্চ ৩৯টি পর্যন্ত হতে পারে। নির্বাচনের সুবিধার্থে উপজেলা ও জেলা পরিষদেও ওয়ার্ড রাখার কথা বলেছে কমিশন। এখন প্রতিটি ইউনিয়নে ৯টি করে ওয়ার্ড রয়েছে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। বলা হয়েছে, নির্বাচিত সদস্যরা ভোটার সমাবেশে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে শপথনামা উচ্চ স্বরে পাঠ করে তাতে স্বাক্ষর করবেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত রোববার জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কমিশন ৫১টি সুপারিশ করেছে। গত বছরের ১৮ নভেম্বর স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে আট সদস্যের স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের আইনি কাঠামো, সাংগঠনিক কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থাটি অসম পদ্ধতিতে বিন্যস্ত আছে। এটিকে একটি সমজাতীয় পদ্ধতিতে পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
ওয়ার্ড নির্ধারণ হবে যেভাবে
বর্তমানে পাঁচ স্তরের স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় ৪ হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদ, ৬৪টি জেলা পরিষদ (তিন পার্বত্য জেলাসহ), ৩৩০টি পৌরসভা এবং ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাজ ও কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলছে, জেলা পরিষদ হবে একটি বিকেন্দ্রীকৃত পরিকল্পনা ইউনিট। ডেপুটি কমিশনারের (ডিসি) অফিস পৃথকভাবে এখন যেভাবে জাতীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছে তা-ই করবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করবে। তার ওপর ভূমি ব্যবস্থাপনার সব বিদ্যমান দায়িত্ব বহাল থাকবে। আর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ডিসির কার্যালয় বাদে জেলার সব উন্নয়ন ও সেবাসংক্রান্ত দপ্তরগুলো জেলা পরিষদে ন্যস্ত থাকবে। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাবেন। একইভাবে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদে সংশ্লিষ্ট স্তরের দপ্তরগুলোতে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাজ ও অর্থসম্পদ পরিষদে ন্যস্ত হবে। প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদে সচিব ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দুটি আলাদা পদ থাকবে। তবে উপজেলা
নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ডিসির অধীনে থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করবেন। তিনি উপজেলা পরিষদের হস্তান্তরিত কর্মকর্তা হবেন না।
বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের আইনি কাঠামো, সাংগঠনিক কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থাটি অসম পদ্ধতিতে বিন্যস্ত আছে। এটিকে একটি সমজাতীয় পদ্ধতিতে পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশনে প্রস্তাব হলো, ভবিষ্যতে জনসংখ্যা ও আয়তনের ওপর ভিত্তি করে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ঢালাওভাবে না বাড়িয়ে ওয়ার্ডের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড ব্যবস্থায় অসমতার কথা তুলে ধরে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসংখ্যাভেদে ছোট, মাঝারি, বড়, অতি বড় ইউনিয়ন রয়েছে। আবার ভৌগোলিক আয়তনেও বড় বা ছোট ইউনিয়ন আছে। ইউনিয়ন পরিষদের জনসংখ্যা চার হাজার থেকে ঊর্ধ্বে চার লাখ (সাভারের ধামসোনা) পর্যন্তও বিস্তৃত। ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখের জনসংখ্যার ইউনিয়ন পরিষদও আছে। এ ক্ষেত্রে রাঙামাটির সাজেকের কথা উল্লেখ করে কমিশন বলছে, সেখানকার কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা নিজের ওয়ার্ড পুরোটা ঘুরে দেখতে পারেননি।
কমিশনে প্রস্তাব হলো, ভবিষ্যতে জনসংখ্যা ও আয়তনের ওপর ভিত্তি করে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ঢালাওভাবে না বাড়িয়ে ওয়ার্ডের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। কারণ, পরিষদ বাড়লে সরকারি ব্যয় বাড়ে। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সংখ্যা সর্বনিম্ন ৯টি থেকে সর্বোচ্চ ৩৯টিতে সীমাবদ্ধ করা যায়। এ বিষয়ে কমিশন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ তুলে ধরেছে। জনসংখ্যা ও আয়তনের সামঞ্জস্য বিধান করে নির্বাচন কমিশন আইনানুযায়ী ওয়ার্ড সংখ্যা নির্ধারণ করে দিতে পারে বলে মনে করে কমিশন।
কমিশন বলছে, নির্বাচিত সদস্যরা নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে শপথনামা পড়বেন এবং স্বাক্ষর করবেন। পরিষদ বা কাউন্সিলের বাইরে থেকে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে ডেকে সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানোর প্রয়োজন হবে না।
দেশের কোন ইউনিয়নে কতগুলো ওয়ার্ড হতে পারে, তারও একটি তালিকা করে দিয়েছে কমিশন। বলা হয়েছে, আড়াই লাখের বেশি জনসংখ্যার ইউনিয়ন পরিষদ আছে সাতটি। এগুলোকে ৩৯টি ওয়ার্ড, দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখের নিচে জনসংখ্যা থাকা পাঁচটি ইউনিয়নকে ৩৬টি করে ওয়ার্ড, এক লাখ থেকে দেড় লাখের নিচে থাকা ৯টি ইউনিয়নে ৩৩টি করে ওয়ার্ড,
৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজারের নিচে জনসংখ্যা থাকা ৩০৩টি ইউনিয়নে ২৭টি করে ওয়ার্ড করা যেতে পারে। এভাবে ৪ হাজার ৫৭৮টি ওয়ার্ডের প্রতিটির জন্য কতটি ওয়ার্ড হবে, তা উল্লেখ করে দিয়েছে কমিশন।
উপজেলা ও জেলায় কী হবে
বর্তমানে উপজেলা পরিষদে কোনো ওয়ার্ড নেই। কমিশন বলছে, ছোট ও মাঝারি সব ইউনিয়ন উপজেলা পরিষদের তিনটি ওয়ার্ড বা নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত হবে। তবে ব্যতিক্রমী বড় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে পাঁচটি ওয়ার্ডও হতে পারে। একইভাবে জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য তিন থেকে পাঁচটি ওয়ার্ডে বিভক্ত হতে পারে। জেলা ও উপজেলা ওয়ার্ডগুলো শুধু নির্বাচনের জন্য ব্যবহৃত হবে। এসব ওয়ার্ড সদস্যদের কোনো নির্বাহী দায়িত্ব থাকবে না। কারণ, ওই এলাকাগুলোর সবকিছু ইউনিয়ন পরিষদ দেখাশোনা করে।
ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে শপথ
ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন সংসদীয় পদ্ধতির আদলে করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে সদস্য বা কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচন করা হবে। এরপর নির্বাচিত কাউন্সিলর ও সদস্যদের ভোটে চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হবেন।
কমিশন বলছে, নির্বাচিত সদস্যরা নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে শপথনামা পড়বেন এবং স্বাক্ষর করবেন। পরিষদ বা কাউন্সিলের বাইরে থেকে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে ডেকে সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানোর প্রয়োজন হবে না।
কমিশনপ্রধান তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সুপারিশগুলো অবশ্যই বাস্তবায়নযোগ্য। এগুলো বাস্তবায়িত হলে ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সম্ভব হবে এবং তৃণমূল থেকেই গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু হবে।