Image description

মারিয়া সুলতানা এখন আড়াই বছর বয়সী একটি মেয়েকে নিয়ে চরম আর্থিক সংকট ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। শিশু মেয়েকে নিয়ে কী করবেন, জানেন না তিনি। তান স্বামী শহীদ মো. নাজমুল কাজী। গত বছর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের মাঝে শুকনো খাবার ও পানি বিতরণ করতে গিয়ে প্রাণ হারান।

তিন সদস্যের পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন নাজমুল। তার শহীদ হওয়ার পর আড়াই বছর বয়সী মেয়ে ও সংসার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মারিয়া।

মারিয়া ও তার মেয়ে আরিয়ানা কাজী নুজাইরা বর্তমানে রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকার মোহাম্মদবাগে একটি দুটি কক্ষের একটি ফ্ল্যাটে বাস করছেন। তার শ্বশুর সেলিম কাজী, শাশুড়ি নাজমা বেগম এবং দুই দেবর সাজারুল ও হামজা গ্রামে থাকেন।

৩৪ বছর বয়সী নাজমুল একসময় কেমিক্যাল ব্যবসা করতেন। ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে শুকনো খাবার ও পানি বিতরণ করার সময় নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। এক ফেসবুক পোস্টে আন্দোলনকারীদের খাবারের প্রয়োজনীয়তার কথা পড়ে তিনি ঘর থেকে বের হয়েছিলেন।

বাকরুদ্ধ মারিয়া বলেন, ‘আমার স্বামী ছিলেন খুব দয়ালু মানুষ। ওই দিন বিকাল ৪টার দিকে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখে তিনি বাড়ি থেকে বের হন। আমিও তার সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মাত্র দুই বছর বয়সী ছোট মেয়ের কারণে উনি আমাকে সঙ্গে নেননি।’

তিনি বলেন, ‘উনি বাড়ি থেকে বের হওয়ার এক ঘণ্টা পর এক শিক্ষার্থী ফোন করে জানান যে নাজমুলকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’

মারিয়া জানান, খাবার বিতরণের সময় সরকারপন্থী একদল সন্ত্রাসী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। কেউ একজন ভারী কিছু দিয়ে নাজমুলের মাথায় আঘাত করে। পরে তার মোবাইলটিও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মারিয়া যখন হাসপাতালে পৌঁছেন, তখন নাজমুলের নিথর দেহ স্ট্রেচারে পড়ে ছিল।

‘হামলায় আমার স্বামী মাথায় গুরুতর আঘাত পান। কিন্তু তার ক্ষতস্থানে একটা ব্যান্ডেজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আমি চিৎকার করে আহাজারি করছিলাম। তখন কয়েকজন ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে শনির আখড়ার অনাবিল হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসাও না দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হ ‘, বলেন মারিয়া।

মারিয়া অভিযোগ করে বলেন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ওই সময় হাসপাতালে আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা না দিতে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিল।

নাজমুলের মরদেহের ছাড়পত্র নিতে গিয়েও পরিবারকে চরম হয়রানির শিকার হতে হয় বলে জানান মারিয়া। পরদিন বিকাল ৪টার দিকে তারা মরদেহ বুঝে পান এবং তাকে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।

মারিয়া বলেন, তার স্বামী কানাডা যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এক বছর আগে ব্যবসা বন্ধ করে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ শুরু করেন। নিহত হওয়ার দিন সকালে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কান দূতাবাসে ভিসার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন। এখন সেসব কাগজ শুধুই স্মৃতি।

নিজের কঠিন পরিস্থিতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা নেই, ভাই নেই, কেবল এক বোন আর দুলাভাই আছেন। শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকেও তেমন কোনো সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই।’

নাজমুলের স্বপ্ন ছিল মেয়েকে চিকিৎসক বানাবেন। কিন্তু এখন সেই স্বপ্ন পূরণের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না মারিয়া। কারণ এত ছোট মেয়েকে রেখে কোথাও চাকরি করাও সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। ফলে স্বপ্ন তো দূর, বর্তমান আর্থিক সংকট তাকে ঘিরে ধরেছে।

মারিয়া বলেন, ‘এ অবস্থায় শহরে থাকা কষ্টকর, আবার গ্রামে যাওয়ারও উপায় নেই। ২৪ বছর বয়সে বিধবা হওয়ার যন্ত্রণাটা আপনারা কেমন করে বুঝবেন?’

তিনি সরকারের কাছে সহায়তা চেয়ে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারসহ পরবর্তী যারাই ক্ষমতায় আসুক, অন্তত এতিম শিশুদের কথা বিবেচনা করে শহীদ পরিবারগুলোর কথা ভাবতে হবে।’

সব হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমার চোখের সামনেই অনেক নিরীহ মানুষ মারা গেছে। কেউ বোঝে না এই কষ্ট, কেবল যারা হারিয়েছে, তারাই জানে।’

বর্তমানে জামায়াত থেকে পাওয়া এক লাখ টাকা দিয়েই কোনোভাবে সংসার চালাচ্ছেন বলে জানান মারিয়া।

তিনি জানান, শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা হারানোর কয়েক দিন আগে শহীদ পরিবারের জন্য ১০ লাখ টাকার একটি চেক দিয়েছিল, কিন্তু তখন জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় তিনি তা ভাঙাতে পারেননি। এখন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সহায়তা কামনা করেন তিনি।

নাজমুলের বাবা সেলিম কাজী (৫০) বলেন, ‘ছেলের মৃত্যু আমাদের পুরো পরিবারকে বিপর্যস্ত করেছে। প্রতি মাসে ওর পাঠানো ২০ হাজার টাকায় সংসার চলত। এখন আমি গরুর দুধ বিক্রি করে কোনোরকমে দিন পার করছি।’

তিনি বলেন, পরিবারের চাহিদা মেটাতে ধার করে ছোট ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। নাজমুল ছিল খুব সহজ-সরল ছেলে। আমি এখনো ‘আব্বা’ ডাক মিস করি। বাকি দুই ছেলের মুখে সেই ডাক শুনেও সাধ মেটে না।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সেলিম কাজী।

সূত্র : বাসস