Image description

২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার হন রংপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সেবিকা। এ ঘটনায় মামলা করেন তিনি। কিন্তু ন্যায় বিচারের আশায় একে একে ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। আইনি জটিলতার কারণে ঝুলে থাকা মামলা নিয়ে লড়তে গিয়ে প্রতিবছর তাতে খরচ বাড়ছে।

এটি শুধু ওই সেবিকার বেলায় নয়, এমন অসংখ্য মামলার জট আর জটিলতায় ঝুলছে হাজারো ভুক্তভোগী। বছরের পর বছর ধরে তারা শুধু ন্যায় বিচারের আশায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন।

জানা গেছে, বছরের পর বছর বিচার না হওয়ায় মামলার জট সৃষ্টি হয়েছে রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। বর্তমানে সাড়ে ৬ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে, তার মধ্যে শুধু ধর্ষণের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাই আছে অন্তত দেড় হাজার। 

এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, সরকার এ সংক্রান্ত নতুন আইন পাস করলে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। আর ভুক্তভোগীরা বলছেন, আইনি জটিলতার কারণে মামলা নিষ্পত্তি না হলে খরচের পাশাপাশি ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কাও বেড়ে যায়।

ধর্ষণের শিকার হন ওই সেবিকা আক্ষেপ করে বলেন, ১৫ বছর ধরে ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছি। ২০১০ সালে মামলাটা করেছি। মামলা হওয়ার পরে আজ ১৫ বছর ধরে আদালতের মধ্যে যাওয়া-আসা করছি। কিন্তু আমি সঠিক বিচার পাচ্ছি না। দিনের পর দিন আমার আইনজীবীকে শুধু টাকা দিচ্ছি আর নতুন নতুন তারিখ শুনে ফিরে যাচ্ছি। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কোনো আভাস নেই। শুধু পদে পদে হয়রানি আর খরচ বাড়ছে।

সন্তানকে কোলে নিয়ে আদালতের বারান্দায় আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলেন এক নারী। সঙ্গে তার স্বামী, শ্বশুর এবং বাবার বাড়ির লোকজন ছিল। কথা হলে ওই নারী অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, বিয়ের প্রায় দশ বছর। এর ঠিক দুই বছর আগে ২০১৩ সালে যৌন হয়রানির অভিযোগে তার পরিবার একটি মামলা দায়ের করেছিল। আজো সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। 

এই মামলার কারণে পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিক চাপ সবসময় তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে উল্লেখ করে ভুক্তভোগী বলেন, ন্যায়বিচার পাওয়া আশায় পরিবারকে মামলা করতে সম্মতি দিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর গেল। কিন্তু এখনো কোনো সুরাহা হচ্ছে না। 

আরেক ভুক্তভোগী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ২৪ বছর থেকে এই কোর্টে আসি আর যাই।‌ আজ হবে না কাল হবে নয়তো পরশু হবে। কখনো লম্বা লম্বা তারিখ দেয়। এভাবে বছরের পর বছর শুধু হয়রানি হচ্ছি। কোর্টের দরজায় আসতেছি আর যাচ্ছি কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। রায় হবে হবে করেও হয় না। কোনো সুফল পাচ্ছি না। 

আরেক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, বাদী মারা গেছে ২০১৬ সালে। তার একটা সাক্ষীও আসে না। অথচ আমি এখনও মামলায় ঝুলে আছি। আমার অপরাধ হলে আমি শাস্তি ভোগ করব। সেটাও আমাকে দিচ্ছে না। এভাবেই ঝুলে ঝুলে দিন পার করছি। পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে অশান্তিতে আছি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতে মোট তিন হাজার ৬০০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে ধর্ষণ মামলা রয়েছে ৭৯২টি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে এক হাজার ৬২০টি মামলা রয়েছে, এরমধ্যে ৪০০টি ধর্ষণের অভিযোগে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ আদালতে থাকা বিচারাধীন এক হাজার ২১৮টি মামলার মধ্যে ধর্ষণের ৩৫০টি মামলা রয়েছে। সবমিলিয়ে তিন ট্রাইব্যুনালে ছয় হাজার ৪৩৮টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে এক হাজার ৫৪২টি। 

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মনে করছেন, মামলা বিলম্বিত হলে সুযোগ পায় আসামিরা। এ কারণে এমন মামলা গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তি করা উচিত। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা চলে আসে। একারণে নতুন আইনে এসব মামলা নিষ্পত্তি হলে ভালো হতো।

রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী মো. আব্দুর রশীদ চৌধুরী বলেন, অধিবেশনের মধ্যে যদি মামলা না হয় তাহলে মামলা একমাস পরে তারিখ পরতে পরতে দুই থেকে তিন বছর পার হয়ে যাবে। মামলা চলমান গতিতে চলতেই থাকবে কিন্তু বন্ধ হবে না। বন্ধ দিতে গেলে তাকে গ্রাউন্ড দিতে হবে। কেন আজকে মামলার রায় হলো না। পরবর্তী সেশন আরেকটি তারিখ দেবে। তারিখ পেছানো হবে কেন। মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে।

এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত ও ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করা নিয়ে সরকারের নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে মামলাজট কমবে।

রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আফতাব উদ্দিন বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন মোকদ্দমায় যে কোন মামলার নিষ্পত্তি সময়সীমা দেওয়া আছে ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। কিন্তু এই আদেশটা বাধ্যতামূলকই না, এটা একটি হুকুমের আদেশ। এটা বাধ্যতামূলকভাবে আইনটা করা হলে আসামিরা ন‍্যায়বিচার পাবে ও মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।