
আমরা বিচার পাচ্ছি না। আমাদের স্বজনদের ফেরত পাইনি। কোথায় আমাদের বাবারা? আমাদের জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। আমাদের এখনো কেন এভাবে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়? আয়নাঘরে কোনো লোক নেই, তাহলে ওই লোকগুলো কোথায়? ৫ই আগস্টের পর আমাদের এভাবে দাঁড়ানোর কথা ছিল না। কান্না চোখে এভাবে কথাগুলো বলছিল গুমের শিকার বংশাল থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃদি।
২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ থেকে নিখোঁজ হন পারভেজ হোসেন। তখন হৃদির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। অবস্থান কর্মসূচিতে হৃদি বলছিল, আমরা বিচার চাই। আমার ভাইটা তো বাবাকে দেখেইনি। আমি শুধু আমার বাবাকে ফেরত চাই।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে। এরপর থেকে আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, গত ১৩ বছর ধরে আমরা রাস্তায় আছি। কিন্তু খুবই বিস্ময় ও আশ্চর্যের ব্যাপার আজকেও আমাদের দাবি আদায়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে। এর থেকে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।
লক্ষ্মীপুরে গুমের শিকার ওমর ফারুকের ছেলে ইমন বলেন, ২০২৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকা থেকে আমার বাবাকে একটি বাহিনীর সদস্যরা তুলে নেয়। আট মাস হয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। আমরা চাই অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের দ্রুত অপসারণ ও আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। যদি তাদের চাকরিচ্যুত করা না হয় তাহলে আমরা নিরাপদ নই, আমাদের পরিবার নিরাপদ নয়।
বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর অভিযুক্ত কর্মকর্তা এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে এই অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে ‘মায়ের ডাক’। অবস্থান কর্মসূচিতে গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। মায়ের ডাকের এই অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে আসেন বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী ও সংগঠনের সদস্যরাও।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর মান্না বলেন, অত্যাচার, নির্যাতনের বিচার না হলে দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা হবে না। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নও অধরা থাকবে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার শাহাদাৎ টুটুল বলেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রশাসনের যারা এসবের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, বাংলাদেশে যেসব গুম-খুন হয়েছে তা ভারতের নির্দেশনায় হয়েছে। সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই’র যারা এতে জড়িত ছিলেন তাদের বিচার করতে হবে।
মায়ের ডাকের সংগঠক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে হাজারও ভাই গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। আজকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আট মাস পরেও অভিযুক্ত কয়জনকে গ্রেপ্তার হতে দেখেছেন? যুদ্ধ যদি একবার হয়ে থাকে প্রয়োজনে আরেকবার যুদ্ধ হবে। যারাই গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল, প্রত্যেক অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
মায়ের ডাকের সমন্বয়ক মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসার সঞ্চালনায় অবস্থান কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ইব্রাহিম কবির মিঠু, হিউম্যান রাইটস সোসাইটির সদস্য সাইফুল ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের মহাসচিব মাহবুব প্রমুখ।
অবস্থান কর্মসূচি শেষে হাইকোর্টের মাজার গেটে চিফ প্রসিকিউটরের প্রতিনিধিদের হাতে স্মারকলিপি তুলে দেয় ‘মায়ের ডাক’। স্মারকলিপিতে ‘মায়ের ডাক’ যে ছয় দফা দাবি জানিয়েছে সেগুলো হলো- আয়নাঘর ও গুম-নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর অভিযুক্ত কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং অবিলম্বে নিশ্চিত করতে হবে যে, এই অপরাধীরা দেশের সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।
খুন-গুম ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত সব অপরাধীকে আইনি প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠাতে হবে।
অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের পদ থেকে অপসারণ এবং তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচারিক তদন্তের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিবি, সিটিটিসি’র সব সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
আয়নাঘর সংরক্ষণের জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে প্রমাণ নষ্ট বা গোপন করা না যায়। প্রমাণ ধ্বংসে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
ভবিষ্যতে গুম, নির্যাতন ও গোপন বন্দিশালার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং সংবিধান ও মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার আনতে হবে।
গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে।