Image description

বোরো মৌসুমের আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের হাওরের ৯০ শতাংশ ফসলই এখনো কাঁচা। নেত্রকোনার হাওরেও পাকেনি বেশির ভাগ জমির ধান।

বোরো মৌসুমের আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের হাওরের ৯০ শতাংশ ফসলই এখনো কাঁচা। নেত্রকোনার হাওরেও পাকেনি বেশির ভাগ জমির ধান। এর মধ্যে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর, যা চিন্তায় ফেলেছে ওই অঞ্চলের কৃষকদের। তারা জানিয়েছেন, মাঠের সব ধান পাকতে আরো সপ্তাহ দুয়েক লাগতে পারে। তার আগে অতিবৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পাশাপাশি উজানের ঢলে হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙে ডুবে যেতে পারে ফসল। তাই আকাশে মেঘ করলেই বাড়ে আতঙ্ক। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে নদীর পানি। আগাম বন্যার শঙ্কায় কাটছে দিন।

দেশের মোট উৎপাদিত ফসলের প্রায় ৩০ শতাংশ জোগান আসে হাওরাঞ্চল থেকে। বর্ষাকালের হাওরের বিস্তৃত জলরাশি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে শুকিয়ে যেতে থাকে। সেখানে কৃষকরা ভূমির বৈশিষ্ট্যভেদে নানা ধরনের ফসল চাষ করেন। নিম্নভূমিতে করেন ধান চাষ। তবে প্রতি বছরই পাহাড় থেকে নেমে আসা আকস্মিক ঢলে এসব ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা সার্বিক খাদ্য জোগানও ব্যাহত করে। বোরো ধানের সঙ্গে তাই বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পাশাপাশি বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও সম্প্রতি ভারতের উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জের কৃষি বিভাগ আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় পাকা ধান দ্রুত কাটতে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে। উজানে ভারি বৃষ্টির এমন পূর্বাভাসে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের কৃষকরা চিন্তিত। কারণ ধান এখনো পুরোপুরি পাকেনি।

 

শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাখিমারা হাওরের কৃষক মহিবুর রহমান বলেন, ‘আমি এবার চার একর জমিতে ধান আবাদ করেছি। আগাম জাতের এক একরের ধান পেকে যাওয়ায় কেটে ঘরে তুলেছি। বাকি ধান পাকতে আরো সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। এখন বৃষ্টিপাতের যে খবর শুনছি তাতে ভয়ে আছি।’

 

দেখার হাওরের কৃষক রইস মিয়া বলেন, ‘আমার জমির ধান এখনো পাকেনি। ডিসি সাহেব (জেলা প্রশাসক) ধান কাটতে বলেছেন। এখন আমি কি কাঁচা ধান কাটব? ভারি বৃষ্টিপাত হলে তো আমরা মাঠে মারা যাব। একদিকে বাঁধ ভাঙা, অন্যদিকে জলাবদ্ধতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এবার সুনামগঞ্জের বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে। এখনো সিংহভাগ জমির ফসল কাঁচা। তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাওরসহ উঁচু এলাকার ১৮ ভাগ ধান কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, ‘যেহেতু আবহাওয়া খারাপ হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে, তাই কালক্ষেপণ না করে কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শুধু কৃষি নয়, হাওরসংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।’

সরজমিনে সুনামগঞ্জ সদর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ জমির ফসল কাঁচা অবস্থায় রয়েছে। কিছু জমিতে ধান কাটতে দেখা গেলেও তার পরিমাণ খুবই কম।

শান্তিগঞ্জের পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান জায়গীরদার বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে এখনো ৯০ ভাগ জমির ফসল কাঁচা। পুরোপুরি ধান পাকতে আরো সময় লাগবে। এখন বৃষ্টিপাত হলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’

দিরাই উপজেলার তাড়ল গ্রামের রাজন চৌধুরী ১০ একর জমিতে ধান লাগিয়েছেন এবার। আগাম জাতের ধান কাটা শুরু করেছেন, আবহাওয়া ভালো থাকলে দ্রুত সময়ে বাকি ধানও কাটা শেষ করতে পারবেন বলে জানান।

ধল গ্রামের আব্দুল খালিক বলেন, ‘শ্রমিকের কিছুটা সংকট রয়েছে। তবে অনেক শ্রমিক এসেছেন। শুধু আবহাওয়াটা খারাপ না হলে আশা করা যায় দ্রুত ধান তোলা যাবে।’

সামারচর গ্রামের বাসিন্দা অরবিন্দ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতেও বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে সব এলাকায় নয়। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস সত্য হলে ধান তোলার ব্যাপারে ঝুঁকি আছে।’

ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাসে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত ধান কাটার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে সংস্থাটির সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ‘আগামী এক সপ্তাহ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিতে হাওরের নিচু এলাকার জমির ধান নষ্ট হতে পারে। আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত ধান কাটার ব্যবস্থা করতে হবে।’

এক ফসলি এসব জমির দিকে সারা বছর তাকিয়ে থাকেন হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার কৃষক। তবে সবচেয়ে বেশি ধান হয় নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ জেলায়। তবে ১৫ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ধান কাটার চূড়ান্ত মুহূর্তে বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলের আশঙ্কা রয়েছে। তাই দ্রুত ধান কাটার তাগিদও দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

ভারতের মেঘালয় চেরাপুঞ্জিতে শুক্রবার থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলেও মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে জানান সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। ফলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি হাওরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এতে আতঙ্কিত না হয়ে কৃষকদের বলব—হাওরে পাকা ধান যেন কালবিলম্ব না করে কেটে ফেলেন। ধান কাটতে গিয়ে শ্রমিক সংকট দেখা দিলে ছাত্র প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন তারা তথ্য পেলে সহযোগিতা করবেন। এছাড়া কৃষি বিভাগ কৃষকদের সেবায় সার্বক্ষণিক সচেষ্ট রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ফসল রক্ষা বাঁধে নজরদারি বাড়াতে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিগুলোকে (পিআইসি) নির্দেশনা দেয়া আছে। সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু হলেও গত তিনদিন ধরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। বজ্রপাতের কারণেও কৃষকদের সতর্কতায় প্রশাসন মাইকিং করেছে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভারি বর্ষণে আগাম বন্যার শঙ্কা নিয়ে ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণীরা। এরই মধ্যে হাওর এলাকায় ৩১ ভাগ ধান কাটা হয়েছে জানিয়ে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শতভাগ ধান কাটা শেষ হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।

নেত্রকোনার ১০ উপজেলার মধ্যে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলা হাওরপ্রধান হলেও কলমাকান্দা, আটপাড়া ও কেন্দুয়া উপজেলায় বেশকিছু হাওর রয়েছে। এসব হাওরে বর্তমানে দ্রুতগতিতে চলছে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। এ বছর হাওরে স্বল্পজীবনকালীন ও উচ্চফলনশীল জাতের ব্রি-ধান-৮৮, ব্রি-ধান-৯২-এর মতো হাইব্রিড জাতের ধান রেকর্ড পরিমাণে চাষ করেছেন কৃষক।

খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামের কৃষক মো. আবুল কালাম বলেন, ‘এলাকার কৃষকরা আনন্দের সঙ্গে ধান কাটার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দুইদিনের বৃষ্টিতে ধান কাটায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে তেমন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এখন ভয়ের কারণ বজ্রপাত।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় এ বছর মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাওরে আবাদ হয়েছে ৪১ হাজার ৭৫ হেক্টর জমিতে। এরই মধ্যে ১২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমির ধান কর্তন হয়েছে, যার পরিমাণ ৩১ ভাগ ধান কাটা সমাপ্ত হয়েছে।

নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, ‘বোরো মৌসুমে হাওরের কৃষকরা যাতে আগাম বন্যা থেকে ফসল রক্ষা করতে পারেন সেজন্য কৃষি শ্রমিকের পাশাপাশি এক হাজারেরও বেশি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ১২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে, যা রোপণ করা ধানের ৩১ ভাগ।’ ৩০ এপ্রিলের মধ্যে হাওরে শতভাগ ধান কাটা শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বৃষ্টির পাশাপাশি নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের কৃষকের মাঝে বজ্রপাতের আতঙ্কও রয়েছে। খালিয়াজুরীর পৃথক স্থানে গত মঙ্গলবার বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হন একজন। তাই প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য মাইকিংও করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে থেকে হাওরাঞ্চলের কোনো কোনো জায়গায় বিশেষ করে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেবে না বলে আশা করছি। এর আগেই ধান কাটা শেষ হবে। তবে হাওর এলাকায় বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতের কারণে কৃষকদের সতর্ক থাকার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে।’