
দেশে উদ্ধার না হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্বাচনকালীন সময়ে অপরাধমূলক সহিংস কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার উত্খাতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া পুলিশের এক হাজার তিন শর বেশি আগ্নেয়াস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। আড়াই লাখের বেশি গোলাবারুদেরও হদিস নেই। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পরবর্তী নির্বাচনের সময় অবৈধ অস্ত্রধারীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভোটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা না গেলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী লুণ্ঠিত এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন দাগি সন্ত্রাসী, জেল পালাতক আসামি, চরমপন্থী ও কিশোর গ্যাংয়ের হাতে। এই অস্ত্রে হত্যাকাণ্ডও ঘটছে। কিছু অস্ত্র চলে গেছে ডাকাত-দস্যুদের হাতে, যা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। নিয়মিত যৌথ অভিযানেও লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে আশানুরূপ সাফল্য মিলছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) এনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, লুণ্ঠিত অনেক আগ্নেয়াস্ত্র এর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার না হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যত দিন পর্যন্ত এসব অস্ত্র উদ্ধার না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত বিশেষ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এ তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে সারা দেশে পুলিশ সুপারদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চলছে।
সম্প্রতি পুলিশ সদরদপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বৈঠকে অপরাধীদের তালিকা প্রকাশ করে অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পরবর্তী নির্বাচনে যাতে এসব অস্ত্রের প্রভাব না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখছেন তাঁরা। অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলছে।
পুলিশের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, লুণ্ঠিত কিছু অস্ত্র চরমপন্থীদের হাতে চলে গেছে। কিছু অস্ত্র সুন্দরবনকেন্দ্রিক দস্যুদের হাতে চলে গেছে। কিছু অস্ত্র শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগীদের কাছে। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকার বিচ্ছিন্নতাবাদীসহ কারাগার থেকে পলাতক অপরাধ জগতে এই অস্ত্র চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় আলোচনা হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছাড়াও পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান সভায় উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ সদরদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৬৬৪টি থানা রয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও বক্সসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও স্থাপনায় আগুন, হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এ সময় পুলিশের পাঁচ হাজার ৭৫০টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। গোলাবারুদ লুট হয় ছয় লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে চার হাজার ৩৭৩টি। এখনো এক হাজার ৩৭৭টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), শটগান, পিস্তল, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি।
উদ্ধার না হওয়া গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে লক্ষাধিক বিভিন্ন বোরের গুলি, টিয়ার গ্যাসের শেল, টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড, সাউন্ড গ্রেনেড, কালার স্মোক গ্রেনেড, সেভেন মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড, ফ্ল্যাশ ব্যাংক গ্রেনেড, হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে।
পুলিশ বলছে, গত ৫ আগস্ট দায়িত্বরত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ৩২টি অত্যাধুনিক অস্ত্রও লুট হয়। এসব অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। যার মধ্যে এসএমজি টি-৫৬, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি ড্রোন গান, অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ও বেতার যোগাযোগের ডিভাইসও ছিল। এখনো সেসব অস্ত্র উদ্ধারের তথ্য মেলেনি। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, লুট হওয়া ওই অস্ত্রগুলো হাতবদল হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে।
পুলিশ সদরদপ্তর বলছে, আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি ওই সময় পুলিশের সাড়ে ছয় লাখের বেশি গোলাবরুদ লুট হয়। এর মধ্যে এ পর্যন্ত চার লাখের মতো গোলাবারুদ জব্দ করা হয়েছে। আড়াই লাখের বেশি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন অপরাধে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে জানিয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, গত ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ঝরনাপাড়ায় অভিযান চালিয়ে ১৬ রাউন্ড গুলি, এক রাউন্ড রাবার বুলেটসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ডবলমুরিং থানার চৌমুহনীর চারিয়াপাড়ায় অভিযান চালিয়ে একটি এলজিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া ওই শহরের শাহীন একাডেমি এলাকা থেকে ফেনী মডেল থানার খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও গুলিসহ মো. রুবেল নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সন্ত্রাসী দলের সদস্য। গত ৩ এপ্রিল খুলনা নগরে পুলিশের লুণ্ঠিত শটগান ও কার্তুজসহ তিন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার দোগাছী এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস লেন থেকে শাহিদা আক্তার (২২) নামে এক নারীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে শাহিদার ‘প্রেমিক’ তৌহিদ শেখ ওরফে তন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তন্ময়ের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, ঢাকার ওয়ারি থানা থেকে লুট করা পিস্তল দিয়ে সে শাহিদাকে গুলি করে হত্যা করে। তার তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ পিস্তলটি উদ্ধার করে। হত্যার দায় স্বীকার করে তৌহিদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
সম্প্রতি নোয়াখালী থেকে কিশোর গ্যাংসহ অন্য সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। গত ৫ নভেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানা পুলিশের অভিযানে সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী এলাকা থেকে ৯টি ম্যাগাজিন, পাঁচটি বিদেশি পিস্তলসহ ১৭টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৭৭ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার এবং পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর বাইরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভাক্যাম্পের গোলাগুলিসহ একাধিক হত্যাকাণ্ডে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করা হয় বলে পুলিশ জানায়।
পুলিশ বলছে, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। অপরাধ বিশ্লেষক ও সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের অস্ত্র অন্যের কাছে থাকাটা বিপদজ্জনক। এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুন-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ ঘটাতে আমরা দেখছি। সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে, তাই এর আগেই এ ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি।