Image description
ঢাকার খাল-নর্দমা পরিষ্কারে অগ্রগতি নেই । বড় উন্নয়ন তো দূরের কথা, ছোট কাজগুলোও করছে না সিটি করপোরেশন-অধ্যাপক আকতার মাহমুদ । জলমগ্নতার দুর্ভোগ এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানোর প্রত্যয় দুই সিটি করপোরেশনের ।

অসহ্য গরম, সঙ্গে ঝড়ো বাতাস আর মেঘের গর্জন, মাঝেমধ্যে হালকা বৃষ্টি-বৈশাখের এমন পরিবেশ ঢাকাবাসীর জন্য স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা থাকলেও জলাবদ্ধতার আতঙ্কে অস্বস্তিতে নগরবাসী। একটু ভারি বর্ষণ হলেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় নগরীর মানুষ। এ নিয়ে পতিত সরকারের রথী-মহারথীদের কাছ থেকে দেড় দশকের বেশি সময় আশার কথা শোনা গেলেও নগরবাসীর মনে শঙ্কা আরও জেঁকে বসেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও শোনা যাচ্ছে সেই শঙ্কার কথাই। গণ-অভ্যুত্থানের পর কার্যত স্থবিরতা বিরাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে। এ কারণে খাল ও নর্দমা পরিষ্কার এবং এর উন্নয়নে তেমন কোনো কাজই হয়নি। আর এ কারণেই অন্য বছরের তুলনায় এবার জলাবদ্ধতা বেশি হওয়ার আশঙ্কা খোদ দায়িত্বপ্রাপ্তদের মুখেই।

চলতি মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে বুধবার নগরীর বিভিন্ন এলাকার সড়ক এবং অলিগলি তলিয়ে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত থাকবে। মাঝেমধ্যে হবে ভারি বর্ষণও। কথা হয় নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল, নর্দমার বড় উন্নয়ন প্রয়োজন। সঙ্গে রুটিন কিছু কাজও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো খাল-নর্দমাগুলো পরিষ্কার রাখা এবং পানি নিষ্কাশন নেটওয়ার্ক সচল রাখা। কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলে এর সমাধান করা; এখানে কোনো কাজই হচ্ছে না। তিনি জানান, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশন খাল ও নর্দমার দায়িত্ব বুঝে নিলেও নিজেরা স্বতন্ত্র বিভাগ বা সার্কেল পর্যন্ত গড়ে তুলতে পারেনি। প্রস্তাবিত সার্কেল করে কাজ করলেও সেখানে ড্রেনেজ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো লোকই নেই। পাশাপাশি খাল-নর্দমার টেকসই উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

জলাবদ্ধতার হটস্পট : দুই সিটিতে জলাবদ্ধতার শতাধিক হটস্পট চিহ্নিত করা হলেও এর সমাধানে কার্যকরভাবে কিছুই করতে পারেনি নগর সংস্থা দুটি। দক্ষিণ সিটির বড় হটস্পটের তালিকায় রয়েছে ঢাকা কলেজ এলাকা, নায়েম সড়ক, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, বকশীবাজার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, জুরাইন আলমবাগ এবং ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিতালী স্কুল রোড। এছাড়া রাজারবাগ গ্রিন লাইন বাস কাউন্টারের সামনের সড়ক, মুগদা প্রধান সড়ক ও মুগদা হাসপাতালের আশপাশের এলাকা। উত্তরের হটস্পটের তালিকায় রয়েছে ডিএনসিসিভুক্ত নতুন এলাকা, বাড্ডা, ভাটারা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, হরিরামপুরসহ পুরো এলাকা। তবে গত বছরের তুলনায় জলাবদ্ধতা কিছুটা কম হতে পারে; গত বছর সেখানে কোনো ড্রেনেজ লাইন ছিল না। পরে কিছু ড্রেনেজ লাইন হয়েছে। বিমানবন্দর সড়ক হতে পারে বড় জলাবদ্ধতার স্পট। ওই সড়কে কোনো ড্রেনেজ লাইনই নেই। দুই সংস্থার সভায় একবার সিটি করপোরেশন সড়ক ও জনপথ বিভাগকে ড্রেনেজ তৈরির সার্বিক পরিকল্পনা তৈরি করে দিলেও তারা ওই সড়কে ড্রেনেজ লাইন তৈরি করেনি। এবার ভারি বর্ষায় সড়কটি যে তলিয়ে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া বনানী কবরস্থান সড়কের পাশে একটি জলাধার ছিল। সেটি ভরাট করায় ওই সড়কের পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর এ কারণেই প্রতিবছর বর্ষায় সেখানে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। রোকেয়া সরণির ড্রেনেজ সংস্কারকাজ কিছুটা আগালেও ভারি বর্ষণে ওই সড়কে জলাবদ্ধতা হবে। কেননা যেটুকু ড্রেনেজ লাইন তৈরি করা হয়েছে, ভারি বর্ষণে তাতে কোনো কাজ হবে না।

খাল উন্নয়নে কচ্ছপগতি : ঢাকা নগরীতে একসময় অর্ধশত খাল ছিল। পরিবেশ-প্রতিবেশ বিবেচনায় না নিয়ে যেনতেন উন্নয়নকাজের কারণে অনেক খাল ভরাট হয়েছে। কিছু খাল দখলে হারিয়ে গেছে। এজন্য দায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ও ব্যক্তি পর্যায়ে।

কিছু খালের দেখভাল করত ঢাকা ওয়াসা, কিছু সিটি করপোরেশন এবং কিছু খালের তদারকি করত পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে থাকা খালগুলো দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, ডিসি অফিসের খালগুলোও দুই সিটি করপোরেশন নিজেদের তত্ত্বাবধানে নেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। খালগুলো তদারকি ও উন্নয়নের দায়িত্ব সিটি করপোরেশন নিলেও কার্যত খালগুলোর সংস্কার ও উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারেনি।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খালগুলোর মধ্যে রয়েছে বাইশটেকী খাল, কল্যাণপুর খ খাল, কল্যাণপুর প্রধান খাল, রূপনগর খাল (আরামবাগ), সাংবাদিক কলোনি খাল (প্যারিস খাল), দ্বিগুণ খাল, কল্যাণপুর খাল (আংশিক), গাবতলী খাল, দিয়াবাড়ী খাল, বাউনিয়া খাল, আব্দুল্লাহপুর খাল (আংশিক), রামচন্দ্রপুর খাল, কাঁটাসুর খাল, রাজাবাজার খাল, বেগুনবাড়ী খাল, মহাখালী খাল, মেরাদিয়া-গজারিয়া খাল, গুল্লার খাল, গুলশান খাল, ভাটারা খাল, সুতিভোলা খাল, ডুমনি খাল, তলনা খাল, বাওথার খাল, আমাইয়া খাল, নির্নিচক খাল, ভাটুরিয়া খাল, ছোট পলাশদিয়া খাল, চামুর খান খাল, পলাশিয়া খাল, উজানপুর খাল, গরিন্দপুর খাল, বোয়ালিয়া খাল, বসুন্ধরা আবাসিকের খাল, নতুন রাস্তা সংলগ্ন দেওয়ান পাড়া খাল, জোয়ার সাহারা-কাঁঠালদিয়া খাল, ইব্রাহীমপুর খাল, আব্দুল্লাহপুর খাল, কোটবাড়ী খাল, জুমাই খাল, মৌসাইদ খাল, ধোলাইখাল-১, ধোলাইখাল-২, পরিবাগ খাল, খিলগাঁও বাসাবো খাল, কামরাঙ্গীরচর খাল, কালুনগর খাল, রায়েরবাজার খাল, নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী (জিরানী) খাল ও নয়াখোলা খাল। খাল বুঝে পাওয়ার পর চার বছর পার হলেও এখনো খালের সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজই চলছে। খালের উন্নয়ন তো পরের কথা। খালগুলো পরিষ্কারই রাখতে পারছে না তারা। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খাল উন্নয়নে একটি প্রকল্প অনুমোদন করলেও এখনো এর কাজই শুরু হয়নি। খাল এবং নর্দমা সংস্কার ও পরিষ্কার কাজে অবহেলা চোখে পড়ার মতো।

খাল বাঁচাতে উদ্যোগ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২ ফেব্রুয়ারি নতুন করে খাল বাঁচানোর উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে। সেখানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আমাদের খালগুলোয় পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এজন্য খাল খনন কার্যক্রম চলমান থাকবে। শহরের জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখতে খালগুলোকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসির ৬টি খাল খননের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং আরও ১৩টিসহ ১৯টি খাল খননের কার্যক্রম এ বছরের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা হবে।

নর্দমাগুলো বেহাল : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রায় ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার পানি নিষ্কাশন ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার ঢাকা উত্তর সিটিতে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে রয়েছে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। নগরীর বিদ্যমান বাস্তবতার তুলনায় ঢাকার ড্রেনেজ লাইন খুব কম হলেও নিয়ম মেনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় ভারি বর্ষার মৌসুমে এ ড্রেনগুলো কার্যত পানি নিষ্কাশনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, ভারি বর্ষণ না হলে তেমন জলাবদ্ধতা হবে না। তবে ভারি বর্ষণ হলে কিছু স্পটে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি রয়েছে। সেসব স্পটের জলাবদ্ধতা নিরসনেও কাজ চলমান রয়েছে। তবে খালের টেকসই উন্নয়নের কাজ শুরু হয়নি। এ লক্ষ্যে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে খাল সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. মোহাম্মদ সফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, বর্ষার জলাবদ্ধতা নিরসন খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজ। সরকার ইতোমধ্যে একটি খাল উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এর বাস্তবায়ন কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আর জলাবদ্ধতার হটস্পটের সমস্যার খাল-নর্দমা পরিষ্কার এবং অন্যান্য উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে।