
বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমানের পদত্যাগের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা বিরাজ করছে অনেকদিন ধরেই। প্রশাসনিক কিংবা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম অনেকটাই থমকে গেছে। তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হওয়া, রুটিন দায়িত্ব পালন করা উপাচার্যের ক্ষমতা না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে ইউল্যাব সমস্যার সমাধান কবে?
গত ১ জানুয়ারি উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমানের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। যাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়টির মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বা এমএসজে বিভাগের শিক্ষার্থী। এ আন্দোলন ভিন্ন রূপ ধারণ করে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের মধ্যস্থতায় ৩ জানুয়ারি আন্দোলন স্থগিত করা হয়। এরপর কেটে গেছে সাড়ে তিন মাস। তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গত ২ জানুয়ারি অনলাইনে একটি জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপে এক হাজার ৭২৮ জন অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ অধ্যাপক ইমরান রহমানের পাশে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আর ১২ শতাংশ ভোট পড়েছে ইমরান রহমানের পদত্যাগের পক্ষে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার লে. কর্ণেল (অব.) ফয়জুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘উপাচার্য না থাকায় অভিভাবক শূন্যতায় ভুগছে বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ঠিকভাবেই চলছে। তবে ক্যাম্পাসের উন্নয়ন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হচ্ছে। উপাচার্যের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ইউল্যাবের অচলাবস্থা কাটাতে সরকারের কাছে আহবান জানাচ্ছি।’
ভিসির পদত্যাগের দাবির আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হেনস্তার প্রতিবাদে মানববন্ধন
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে জানা গেছে, ইউল্যাবে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে অধ্যাপক ইমরান রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ উপাচার্যকে স্বপদে বহাল রাখার দাবি করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমানের পদত্যাগের ইস্যুতে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তারা তাদের কাজ শেষ করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় নেবে।’
ঘটনার শুরু যেভাবে
ইউল্যাব কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর ক্যাম্পাসের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকায় দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে ‘চাপের’ মুখে সেটি প্রত্যাহার করা হয়। এই ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অধ্যাপক ইমরান রহমানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের অধিকাংশই এমএসজে বিভাগের শিক্ষার্থী।
‘এমএসজে বিভাগের সঙ্গে বিবিএর বিরোধকে ইচ্ছাকৃতভাবে সামনে আনা হচ্ছে। উপাচার্য বিবিএ বিভাগকে প্রাধান্য দিতেন। এমএসজেকে অবহেলা করতেন। তবে এজন্য তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়নি। ক্যাম্পাসে গ্রাফিতি আঁকার কারণে দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় আন্দোলন করা হয়েছে।’—শিবলী সাদিক, ভিসির পদত্যাগে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী
ইউল্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, ভিসি পদত্যাগের আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে অনেক আগেই। ৫ আগস্টের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানে মাদক সেবনকে কেন্দ্র করে সৈয়দ সাদমান সাকিব নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটানায় সাত শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। ওই শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীতে ভিসি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ৫ আগস্ট পট-পরিবর্তনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় শেখ হাসিনার গ্রাফিতি মুছে ফেলার ঘটনায় দেশ যখন উত্তাল, ঠিক সেই মুহূর্তে ইউল্যাবের গ্রাফিতি আঁকতে বাধা দেওয়ার ঘটনা সামনে নিয়ে আসা হয়।
এ বিষয়ে শরীফ মাহমুদ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সময় উপাচার্য ইমরান রহমান আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। যে ব্যক্তি আমাদের সহযোগিতা করেছেন, তিনি গ্রাফিতি আঁকতে বাধা দেবেন সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মূলত গত ডিসেম্বরে জুলাই আন্দোলনের ছবি নিয়ে ফটো এক্সিবিশন চলছিল। সেখানে কিছু শিক্ষার্থী গ্রাফিতি আঁকার নামে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে। সেজন্য দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সামান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরবর্তীতে সেটি প্রত্যাহারও করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভিসির পদত্যাগ ইস্যুতে গত ১ জানুয়ারি আমাদের শিক্ষকদের যেভাবে ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় তা বর্ণনা করার মতো না। আমরা আন্দোলনরতদের অনেক অনুরোধ করলেও তারা শিক্ষকদের ক্যাম্পাস থেকে বের হতে দেয়নি। একজন নারী শিক্ষককে হেনস্থাও করা হয়েছে। এগুলো ভিসির পদত্যাগের আন্দোলন হতে পারে না।’
শরীফ মাহমুদের এ বক্তব্যের বিরোধীতা করে শাস্তি পাওয়া শিক্ষার্থী রাহাত মুসান্না বলেন, ‘গত ১৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালীন মোহাম্মদপুরের কমিশনার এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। হামলার সময় আমরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে একটি মহলের ইশারায় প্রবেশ করতে পারিনি। যার কারণে আমরা মারধরের শিকার হই। এ ঘটনার বিচার চাইতে ডিসেম্বরে দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকি। হামলার বিচার চাইতে গিয়ে আমাদের অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যার কারণে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন হয়েছে।’
দুই বিভাগের দ্বন্দের কারণে ভিসি পদত্যাগের আন্দোলন
ইউল্যাবে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের দাবি গ্রাফিতি আঁকার ঘটনাটি ইচ্ছাকৃতভাবে সামনে আনা হয়েছে। আন্দোলনের পেছনে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ এবং এমএসজে বিভাগের বিরোধ কাজ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান বিবিএ বিভাগকে প্রাধান্য দেন, এ অজুহাতে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়েছে।
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এমএসজে বিভাগের প্রতি অবহেলার ঘটনার কথা জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, অধ্যাপক ইমরান রহমান বিবিএ বিভাগের ডিন হওয়ায় তিনি এ বিভাগকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যদিও ইউল্যাব পরিচিতি পেয়েছে এমসিজে বিভাগের কারণে।
ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আব্দুল হান্নান মাসউদ
ইউল্যাবের ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থী শিবলী সাদিক বলেন, ‘এমএসজে বিভাগের সঙ্গে বিবিএর বিরোধকে ইচ্ছাকৃতভাবে সামনে আনা হচ্ছে। উপাচার্য বিবিএ বিভাগকে প্রাধান্য দিতেন। এমএসজেকে অবহেলা করতেন। তবে এজন্য তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়নি। ক্যাম্পাসে গ্রাফিতি আঁকার কারণে দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় আন্দোলন করা হয়েছে।’
তবে শিবলী সাদিকের এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন অধ্যাপক ইমরান রহমানকে স্বপদে বহাল রাখার দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থী সৈয়দ সাদমান সাকিব। এমএসজে বিভাগের শেষ বর্ষের এ শিক্ষার্থী জানান, ‘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইমরান রহমান সব বিভাগকে সমানভাবে দেখতেন। যার কারণে এমএসজে বিভাগ কিছুটা মনক্ষুন্ন ছিল। যার ফলশ্রুতিতে এমএসজে বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি করে থাকতে পারেন। কেবলমাত্র গ্রাফিতি আঁকতে বাধা দেওয়া এবং দুই শিক্ষার্থীকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি জায়গায় যেতে বারণ করার কারণে ভিসি পদত্যাগের আন্দোলন হতে পারে না।’
অনলাইন জরিপে ভিসিকে বহাল রাখার পক্ষে অধিকাংশ শিক্ষার্থী
ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গত ২ জানুয়ারি অনলাইনে একটি জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপে এক হাজার ৭২৮ জন অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ অধ্যাপক ইমরান রহমানের পাশে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আর ১২ শতাংশ ভোট পড়েছে ইমরান রহমানের পদত্যাগের পক্ষে।