Image description
 

দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কোচিং-প্রাইভেটের প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। ক্লাসে পড়াশোনার ঘাটতি, দুর্বল শিক্ষার্থী বা বাড়তি শিক্ষা অর্জনে আগ্রহীদের প্রয়োজন মেটাতেই মূলত এসব কার্যক্রম চলে আসছে। তবে সহায়ক এ কার্যক্রমই বর্তমানে গিলে খাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল শিক্ষাকে।

সুযোগ সন্ধানীদের দৌরাত্ম্যে বর্তমানে কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্য মহামারি আকার ধারণ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা ছাড়াও ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে প্রাইভেট-কোচিং সেন্টার।

এতে একদিকে শিক্ষকরা যেমন ক্লাসের পরিবর্তে প্রাইভেট-কোচিংয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন, তেমনি শিক্ষার্থীরাও ক্লাসের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। স্কুলের পাশাপাশি কোচিং-প্রাইভেটে দীর্ঘ সময় লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায় শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে।

প্রয়োজন না থাকলেও এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এতে বাড়তি খরচের পাশাপাশি ভোগান্তিও বাড়ছে অভিভাবকদের।

অন্যদিকে প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলো। যে কারণে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষা শুরুর দিন ১০ এপ্রিল থেকে ১৩ মে পর্যন্ত দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এদিকে নিম্নমাধ্যমিক থেকে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের কোচিং বন্ধে একটি নীতিমালা হলেও তার কোনো কার্যকারিতা নেই। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা এই নীতিমালার বাইরে। এ অবস্থায় কোচিং-প্রাইভেটের লাগাম টেনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার জন্য সরকারের বিশেষ হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকরা। তাদের অভিমত, ক্লাসে যদি শিক্ষকরা ঠিকমতো সময় দেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-কোচিংয়ের খুব বেশি প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক তা না করে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে উৎসাহ, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যও করে থাকেন।

এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর একেএম রিয়াজুল হাসান আমার দেশকে বলেন, শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠ্যবই অনুসরণ করে ঠিকমতো পড়ালে কোচিং-প্রাইভেটের আর কোনো প্রয়োজন নেই। পাঠ্যবই বা সিলেবাস ক্লাসেই শেষ করা সম্ভব।

শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিংয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায়। শিক্ষকদের ক্লাস কার্যক্রমে মনোনিবেশ করা উচিত। তাহলে শিক্ষার্থীরাও পড়ার টেবিলে বসবে, তাদের কোচিংনির্ভরতা লাগবে না।

তবে শিক্ষকদের নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয় জানিয়ে এই শিক্ষক নেতা বলেন, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিলে তারা ক্লাসে মনোযোগী হবেন এবং শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে আগ্রহী হবে।

ইউনেস্কোর এক গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে প্রাইভেট টিউশন গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ওই গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীই প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করে; যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই হার ৫০ শতাংশ। প্রাইভেট টিউশন গ্রহণের হার সবচেয়ে কম ফিজিতে। দেশটিতে মাত্র ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের বাইরে প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করে।

অন্য দেশগুলোর মধ্যে প্রাইভেট টিউশন গ্রহণের হার কাজাখস্তান ও ভিয়েতনামে ৭০ শতাংশ, রিপাবলিক অব কোরিয়ায় ৬৮ শতাংশ এবং ফিলিপাইনে ৩৫ শতাংশ। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাইভেট টিউশনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে কোচিং সেন্টারের সংখ্যা খুব দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের সবখানেই সমান প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সন্তানের ভালো ফল লাভে মা-বাবার উচ্চ প্রত্যাশাকেই এর অন্যতম কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। জানা গেছে, কোচিংবাণিজ্য বন্ধে হাইকোর্টে একজন অভিভাবকের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে একটি নীতিমালা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ শীর্ষক নীতিমালাটি ২০১৯ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

ওই নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের (নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়), কলেজ (উচ্চমাধ্যমিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) মাদরাসা (দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল) ও কারিগরি দীর্ঘদিন যাবৎ এক শ্রেণির শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোচিং পরিচালনা করে আসছেন। এটি বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিংবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন; যা পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে এবং এ ব্যয় নির্বাহে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছেন। এছাড়া অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে কোচিংয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন। এক্ষেত্রে দরিদ্র ও পিছিয়েপড়া শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ সম্পর্কিত হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশন নং ৭৩৬৬/২০১১-এর আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর কোচিংবাণিজ্য বন্ধে একটি গেজেট নোটিফিকেশন বা অন্য কোনোরূপ আদেশ প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি ও হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কোচিংবাণিজ্য বন্ধে সরকার কর্তৃক এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো।

নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে ছাত্রছাত্রীর তালিকা, রোল নং, নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করে জানাতে হবে।

কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনো কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে পারবেন না বা নিজে কোনো কোচিং সেন্টারের মালিক হতে পারবেন না। তবে অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক কোচিংবাণিজ্যে জড়িত থাকলে তার এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতা স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন একধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এই নীতিমালার কোনো প্রয়োগ নেই।

শুধু তা-ই নয়, নীতিমালাটি মনিটরিংয়ের জন্য মেট্রোপলিটন/বিভাগীয় এলাকা, জেলা ও উপজেলার ক্ষেত্রে আলাদা কমিটি গঠন করা আছে। তবে সেটিরও কোনো বাস্তব রূপ দেখা যায়নি।

সূত্রমতে, মেট্রোপলিটন/বিভাগীয় এলাকার জন্য ৯ সদস্যের মনিটরিং টিমের সভাপতি হচ্ছেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক)।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) কেএম আলী আযম বলেন, এ ধরনের কিছু আমার সামনে আসেনি। এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। অর্থাৎ, কোচিং বন্ধের নীতিমালা বাস্তবায়ন বা মনিটরিং নেই।

রাজধানীর ভিকারুননিসা, মনিপুর, আইডিয়ালসহ বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবক জানান, শিক্ষকরা ক্লাসে ঠিকমতো না পড়ানোর কারণে তাদের সন্তানদের প্রাইভেট-কোচিংয়ে দিতে হচ্ছে। স্কুলের ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই কোচিং-প্রাইভেটে ভর্তি চূড়ান্ত করতে হয়। অনেকে খরচ কমসহ অন্য সুবিধার জন্য কোচিং বা অন্য শিক্ষক দিয়ে প্রাইভেট পড়াতে চান। কিন্তু ক্লাসের শিক্ষকদের কাছে না পড়ালে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে মানসিক হয়রানি করা হয়। আর যারা শিক্ষকদের কাছে পড়ে, তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়। সেজন্য বাধ্য হয়ে ক্লাসটিচারদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে পড়াতে হয় সন্তানদের। বাড়তি এই খরচ জোগাতে অনেক অভিভাককে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর প্রাইভেট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন বৃদ্ধির কারণে স্কুলের ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারোরই মনোযোগ বা আগ্রহ থাকছে না।

অভিভাবকরা আরো জানান, প্রভাতী শিফটের স্কুলের ক্লাস শেষ হওয়ার পর আর দিবা শিফটের ক্লাস শুরুর আগে অধিকাংশ শিক্ষার্থী কোচিং বা প্রাইভেটে ব্যস্ত থাকে। এরপর অনেকেই আবার গৃহশিক্ষক বা অন্য প্রাইভেট শিক্ষকদের ক্লাস করে। সব মিলিয়ে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় স্কুলশিক্ষার্থীদের। তারা দিনে ঠিকমতো খাওয়া ও বিশ্রামের সময় পায় না। অনেক অভিভাবক স্কুল বা কোচিং এলাকায় এসে সন্তানদের খাবার খাওয়ান। অনেকে আবার টিফিনে আনা সামান্য খাবার খেয়েই দিন পার করে। এভাবে একদিকে খাওয়ার কষ্ট, অন্যদিকে দীর্ঘ সময় পড়ালেখায় ব্যস্ত থেকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বঞ্চিত হয় তারা। এতে অনেকেই মানসিক ও শারীরিক নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া কোচিং-প্রাইভেটনির্ভরতা বা ক্লাসটিচারদের মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা পেয়ে নিজেদের মেধার বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও অন্যান্য পরীক্ষায় পড়ছে।

প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই), ঢাকার সুপারিনটেনডেন্ট মো. কামরুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক স্কুলের যে সিলেবাস, তাতে প্রতি ওয়ার্কিং ডেতে বা প্রতি ক্লাসে এক পেজও পড়ানো লাগে না। শিক্ষকরা যদি ক্লাসে ঠিকমতো পড়ান, তাহলে শিক্ষার্থীদের আর বাইরে কোচিং-প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বাস্তবে অনেকে পেশাগত দায়িত্ব মনে না করে চাকরি মনে করেন। যে কারণে তারা ক্লাসে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। অনেকে প্রাইভেট টিউশনি করেন। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী শিক্ষকদের কোচিং-প্রাইভেট পড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে কোচিং-প্রাইভেটে জড়িতদের কোনো শাস্তি না হওয়ায় অনেকেই বাড়তি আয়ের জন্য এতে জড়িত থাকেন।

কোচিংবাণিজ্য বন্ধ আন্দোলনের অন্যতম নেতা অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য মহামারি আকার ধারণ করছে। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র, নীতিমালা, বিজ্ঞপ্তি কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। তাদের নীতিমালা মানতে বাধ্য করাতে হবে। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা বাস্তবায়ন করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেবেন— সে প্রত্যাশা অভিভাবকদের। এছাড়া আইন করে শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধ এবং ক্লাসে পাঠদান নিশ্চিতেরও জোর দাবি জানান এই অভিভাবক নেতা।