Image description

দেশের চাকরির বাজার এখনও তুমুল প্রতিযোগিতা তুঙ্গে, বিশেষ করে বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরির পরীক্ষাকে ঘিরে। ঈদের পর আগামী ২৭ জুন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা এবং তার আগেই ৮ মে অনুষ্ঠিত হবে ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা। বিসিএসসহ নানান পরীক্ষা প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কয়েক লাখ চাকরিপ্রার্থী নিজেদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। 

এসব শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ বির্সজন দিয়ে ক্যাম্পাসেই থাকছেন। ঈদ কাটাবেন সেখানে। কেউ নিচ্ছেন পুরোদমে চাকরির প্রস্তুতি। আবার কেউ আত্মীয়-স্বজনদের মুখে বারবার একটাই প্রশ্ন—‘চাকরির কী অবস্থা?’ এই প্রশ্ন এড়াতেই। তাই তারা ঈদে বাড়ি না গিয়ে ক্যাম্পাসের হলে কিংবা মেসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিন।

ঈদ আনন্দ বির্সজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হল থেকে বসে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসলামের ইতিহাস ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. বিল্লাল। বর্তমানে সবাই যখন নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত মো. বিল্লাল তখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্যাম্পাসে থেকেই। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসছে মে মাসেই বসবেন লিখিত পরীক্ষায়। তাই শেষ মূহুর্তে কোন খেয়ালিপনায় রাজি নন তিনি। যেই হিসেব সেই কাজ।

তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ একটি সরকারি জব পাওয়া। এজন্য মাস্টার্স শেষে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। গ্রামে ঈদ সব সমই করি ইনশাআল্লাহ আগামীতেও করবো। আগামীতে যেন বিপুল উৎসাহ আর আনন্দের সাথে ঈদ করতে পারি সে জন্য এবারে কিছু আত্মত্যাগ। মে মাসে পরীক্ষা। সেই প্রস্তুতি সারতেই একটু কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম।

তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সরকারি চাকরি যেন সোনার হরিণ। যা সহজে ধরা দিতে চায় না। সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। একটিমাত্র পদের জন্য শত শত প্রার্থী প্রতিযোগিতা করে থাকে। প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে অবশ্যই সর্বোচ্চ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। এক্ষেত্রে বিসিএসসের প্রাধান্য সবার আগে। সর্বশেষ ৪৭তম বিসিএসে ৩ হাজার ৪৮৭টি পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৪৯২ প্রার্থী। তাই পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো থাকলেও টিকে থাকা সম্ভব নয় অনেক প্রার্থীর। আর ৪৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় ৩ হাজার ১৪০টি পদের বিপরীতে অংশ নেবেন উত্তীর্ণ ১০ হাজার ৬৩৮ জন পরীক্ষার্থী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এবারের ঈদে বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না বেশ কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ সামনে ৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, যা নিয়ে বেশ চাপ অনুভব করছি। তার ওপর আমার বাড়ি ঠাকুরগাঁও, দূরত্ব এতটাই বেশি যে ঈদের সময় যাতায়াতটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সেই সাথে ট্রেনের অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে টিকিট কাটলেও নিজের সিট না পাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তাই আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম, এবার ঈদ ক্যাম্পাসেই কাটাব।

‘‘আরেকটা বাস্তবতা হলো, ব্যাচেলর জীবনে অর্থনৈতিক বিষয় সবসময়ই একটা বড় ফ্যাক্টর। লেখাপড়া শেষে পরিবারসহ সবাই চেয়ে থাকে কিছু একটা করি। সবকিছু মিলিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এটা আমার ক্যাম্পাস জীবনেরও শেষ ঈদ!’’

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আব্দুল আলিম জানান, তার বাড়ি বরিশাল, দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিতে হয় কখনো জলপথে আবার কখনো স্থল পথে এভাবে ভেঙে ভেঙে যাওয়াটা অত্যন্ত ক্লান্তিদায়ক। এছাড়া সদ্য গ্রাজুয়েট শেষ করেছি, ৪৭তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষা সন্নিকটে, তাই পরীক্ষার প্রিপারেশন মজবুত করতেই বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। এছাড়াও তিনি ওয়েব ডেভেলপার। অনেক কাজ জমা হয়ে আছে। ক্লাইন্ট সামলানো, কাজ করা এবং সাবমিট দেওয়া অনেক প্রেশার সামলাতে হচ্ছে। নিজ এলাকাতে ইন্টারনেট সুবিধা ঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। সেই জন্য পরিবারের থেকে দূরে ঈদ যাপন করতে হচ্ছে। তবে, পরিবারের সাথে ঈদের যে আনন্দ সেটা আর কোথাও পাওয়া যায় না বলে জানান তিনি।

স্নাতক শেষের পর চাকরির প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) অনেক শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে ঈদ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের অনেকেই। এই বিষয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সাগর হালদার বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ঈদগুলো কত আনন্দময় ছিল! কত আগ্রহ আর স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু সময়ের সাথে সেই আগ্রহ ম্লান হয়ে গেছে, স্বপ্নও বদলে গেছে। এখন একটাই স্বপ্ন—একটি ভালো চাকরি ও বাবা-মায়ের জন্য কিছু করা। পড়াশোনা শেষ, আর চারপাশের সবার একটাই প্রশ্ন—"আমি এখন কী করছি?" অথচ আমার কাছে এর কোনো স্পষ্ট উত্তর নেই। তাই ঈদ এলেও আর আগের মতো বাড়ি যাওয়া হয় না। অনিশ্চয়তা আর প্রশ্নের ভার যেন আনন্দের পথ আটকে রেখেছে।

ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হেনামুল হাসান হিমু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যখনই ২-৩ দিনের ছুটি পেতাম, তখনই বাড়ির পথে রওনা হতাম। ঈদ এলে টিউশনির আয় বাড়িতে পাঠানোর তাগিদ থাকত। কিন্তু এখন অনার্স শেষ, পরিস্থিতি বদলে গেছে। আত্মীয়-স্বজনদের মুখে বারবার একটাই প্রশ্ন—‘চাকরির কী অবস্থা?’ এই প্রশ্ন এড়াতেই এবার বাড়ি না গিয়ে হলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঈদের পর বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা রয়েছে, তাই নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য সময় নষ্ট করতে চান না।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলেন, "ঈদ মানেই এক অনন্য অনুভূতি— পারিবারিক আবহে উৎসবের আনন্দ, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, আর বিশেষ এক উচ্ছ্বাস। প্রতিবছর পরিবারের সঙ্গেই ঈদ উদযাপন করতাম, কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। সদ্য স্নাতক শেষ করেছি, সামনে বড় স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছি। তাই প্রথমবারের মতো বাড়ির বাইরে, ক্যাম্পাসেই ঈদ কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সঙ্গে না থাকার কারণে কিছুটা খারাপ লাগছে, কিন্তু লক্ষ্য পূরণের পথে এই সামান্য ত্যাগ খুব বড় কিছু নয়।

তথ্যমতে, ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পর্ব ২৭ জুন একযোগে দেশের সব বিভাগীয় শহরে অনুষ্ঠিত হবে। এ বিসিএসে মোট ৩ হাজার ৪৮৭টি ক্যাডার পদের বিপরীতে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৪৯২ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে ২০০ জন, পুলিশ ক্যাডারে ১০০ জন, কৃষি ক্যাডারে ১৬৮ জন, এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারে ১৩৬১ জন নেওয়া হবে।

অন্যদিকে, ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা ৮ মে অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১০ হাজার ৬৩৮ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেবেন। ৪৬তম বিসিএসে ৩ হাজার ১৪০টি পদ রয়েছে, যার মধ্যে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সবচেয়ে বেশি ১,৬৮২ জন, শিক্ষা ক্যাডারে ৫২০ জন, প্রশাসনে ২৭৪ জন, পুলিশে ৮০ জন এবং অন্যান্য বিভাগেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিয়োগ দেওয়া হবে।