Image description

শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি বাংলাদেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের ভ্রু কুঁচকে দিয়েছে। ১৯৫০ সালে আসামে ৮ দশমিক ৬ রিখটার স্কেলে যে দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকম্পটি হয়েছিল, তার ৭৫ বছর পর শনিবার আবার হলো শক্তিশালী এই ভূমিকম্প। বিশিষ্ট ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়াক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ড. মেহেদী আহমদ আনসারী এই ভূমিকম্পের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে আশঙ্কা প্রকাশ করে আমার দেশকে বলেছেন, ভূমিকম্পটি বার্তা দিয়ে গেছে বাংলাদেশসহ হিমালয় পাদদেশ অঞ্চলে যে কোনো সময় আরো একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে।

 

মিয়ানমারের প্রাচীন রাজধানী মান্দালয়ে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল প্রতিবেশী থাইল্যান্ডে। ভূমিকম্পের কাঁপুনি বাংলাদেশ, ভারত, কম্বোডিয়া ও চীন পর্যন্ত অনুভূত হয়েছে। বেশি ক্ষতি হয়েছে মান্দালয়ে। ১৯৩০ সালে মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বাগুতে ৭ দশমিক ৩ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছিল, তাতে ৫৫০ জনের মৃত্যু হয়। ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, দুটি টেকটোনিক প্লেট ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেটের মধ্যে মিয়ানমারের অবস্থান, যা দেশটিকে ভূমিকম্পের বিশেষ ঝুঁকিতে ফেলেছে। এ দুটি প্লেটের মধ্যবর্তী সীমানাকে ‘সাইগং ফল্ট’ বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা এটিকে মিয়ানমারের মান্দালয় ও ইয়াঙ্গুনের মতো শহরগুলোর মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সরল রেখা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা এ অঞ্চলের লাখো মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের মতে, ভারত ও ইউরেশিয়া প্লেটের মধ্যে ঘর্ষণের কারণে মিয়ানমারে ভূমিকম্পটি হয়, যাকে ‘স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্টিং’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

 

ভূমিকম্প বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতি ১০০-১৫০ বছর পরপর ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আসে। আর প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর আসে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৫০ বছরের সাইকেল হিসেবে বাংলাদেশে এখন ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা খুবই জোরালো হয়েছে। গত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পের সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে।

 

সম্প্রতি ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশকে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি বলেন, ‘দুটি থিওরি আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প হলে বড় ভূমিকম্প নাও হতে পারে। আবার বড় ঝাঁকুনির প্রস্তুতি হিসেবে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়ে থাকে। প্রশ্ন হলো আমরা কোনটা বিবেচনায় নিয়ে এগোব। আমাদের তো অবশ্যই সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। বড় ভূমিকম্পের প্রস্তুতি যদি নিই, তাহলে আমরা ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু আমরা যদি মনে করি ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে, তাই বড় ভূমিকম্প হবে না; আর সত্যিই যদি বড় ভূমিকম্প হয়েই যায়, তাহলে যে বিপর্যয় নেমে আসবে— তা কল্পনা করাও অসম্ভব।’

 

তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে যখন নেপালে ভূমিকম্প হয়, তখন আমি সরকারি যে কমিটিগুলোয় কাজ করেছিলাম, বারবার বলেছিলাম রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমরা যেমন ভবনগুলো চেক করেছি, চেক করে সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা করেছি; ঠিক একইভাবে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোর বিল্ডিংগুলো চেক করে সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এত বছর হয়ে গেল; কিন্তু বিষয়টি কেউ কানেই তুলল না।’

 

তিনি জানান, বাংলাদেশে ৮ রিখটার স্কেল মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। আর এ ধরনের একটি ভূমিকম্প হিমালয় পাদদেশ এলাকায় আঘাত হানলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও ভুটানের বড় শহরগুলো। এতে ৫ কোটি মানুষ বিপন্ন হতে পারে। ড. আনসারী রাজধানী ঢাকা নগরীর কথা উল্লেখ করে রাজউককে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এখনই সচেতন না হলে এবং পদক্ষেপ না নিলে আমাদের কঠিন মূল্য দিতে হবে। বহুতল ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মেনে চলার ওপর জোর দেন তিনি।

 

হিমালয় অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন

বাংলাদেশসহ হিমালয় পাদদেশ অঞ্চলে একটি বড় ভূমিকম্প যে ওভারডিউ হয়ে আছে এবং সহসাই যে সেটি আঘাত হানতে পারে, সে আশঙ্কার কথা ‘সায়েন্স’ পত্রিকার এক গবেষণা প্রতিবেদনেও প্রকাশ পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. রজার বিলহ্যামের নেতৃত্বে হিমালয় অঞ্চলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা নিয়ে যে সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে, তাতে উঠে এসেছে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কার কথা। এ গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, হিমালয় পর্বতমালার আশপাশের প্রায় ১২৫০ মাইল এলাকায় রিখটার স্কেলের ৮ দশমিক ১ থেকে ৮ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। এ সমীক্ষায় ড. রজার বিলহ্যাম বলেছেন, গত কয়েক শতাব্দীর ভূমিকম্পে এ এলাকায় ভূ-অভ্যন্তরে জমা হওয়া চাপ কমেছে কি না আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। এতে যে তথ্যউপাত্ত পেয়েছি, তাতে এ সিদ্ধান্তেই এসেছি বড় একটি ভূমিকম্প অত্যাসন্ন। আজ-কাল বা পরশু যে কোনো সময় এ ভূমিকম্প হতে পারে। তবে ঠিক কখন সেটা হবে, তা বলা সম্ভব নয়। কারণ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার কোনো পদ্ধতি এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়নি। বিলহ্যামের নেতৃত্বে বিজ্ঞানী দলের গবেষণায় বলা হয়, ভারতের নিচে যে প্লেট রয়েছে, তা ধীরে ধীরে এশীয় প্লেটের নিচে প্রবেশ করছে। এতে হিমালয় অঞ্চলে চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এ চাপ বৃদ্ধি হিমালয় অঞ্চলের ১২০০ মাইলের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাকে বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশও রয়েছে এ এলাকার ভেতরে। আর হিমালয়ের এই বিপজ্জনক এলাকায় বসবাসকারী পাঁচ কোটি মানুষের জীবন ভীষণ হুমকির মুখে। ওই গবেষণায় বিলহ্যাম আরো জানান, ভারতীয় প্লেটটি ১০০ বছরে ছয় ফুট করে এশীয় প্লেটের নিচে ঢুকছে। এর অর্থ হচ্ছে, ভারতীয় প্লেটের প্রায় ১০টি ফুটবল মাঠের সমআয়তনের স্থান এশীয় প্লেটের নিচে চলে যাচ্ছে। ফলে চাপ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।

 

আরেকটি বিজ্ঞানী দলের সমীক্ষাতেও এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের কথা প্রকাশ পেয়েছে। জিওলজিক্যাল অবজারভেটরি অব কলম্বিয়ার দুজন ভূকম্প বিশারদ ড. লিওনার্দো সিবার ও জন জি আর্মব্রাস্টার ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে তাদের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, খুব সহসাই হিমালয়ের পাদদেশ এলাকাগুলোতে একটি বড় ভূমিকম্প আঘাত হানতে যাচ্ছে। তারা এ অঞ্চলের ৩০০ বছরের ভূমিকম্পের ইতিহাস, এর কারণ, বিভিন্ন তথ্য এবং মাঠ পর্যায়ের ব্যাপক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রণীত সমীক্ষায় এই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন। সমীক্ষায় দেখানো হয়, ৩০ বছর পরপর এ অঞ্চলে একেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে।

 

এ সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে বেশ কবছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মরহুম ড. মনিরুল হক আমাকে জানিয়েছিলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্প প্রতি ১০০ থেকে দেড়শ বছর পরপর চক্রাকারে ঘটে থাকে। এ হিসেবেও বাংলাদেশ, ভারতের আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। ১৯৮৮ সালে নেপাল-বিহারের ভূমিকম্প এবং ২০০১ সালে ভারতের গুজরাটের ভূমিকম্প এর পূর্ব আলামত। এ ভূমিকম্পে ভুজ শহরটি ধ্বংস হয়ে যায়।

 

ঢাকায় সরাসরি ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই, তবে…

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ভূমিকম্প ঢাকায় আঘাত হানলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে। কারণ ঢাকায় একদিকে ঘনবসতি, অন্যদিকে অপরিকল্পিত বাড়িঘর ও সারি সারি হাইরাইজ বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। দিনের বেলায় না হয়ে রাতে ভূমিকম্পটি হলে ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ করে মানুষের মৃত্যু বেশি হবে। তবে ঢাকায় সরাসরি কোনো ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে এর আগেও আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আশ্বস্ত করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমদ আনসারী। তার মতে, এ পর্যন্ত যেসব ভূমিকম্প হয়েছে, সেগুলো বেশির ভাগই ঢাকা থেকে ১৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। শুক্রবার মিয়ানমারের মান্দালয়ে যে ভূমিকম্পটি হয়, তার মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা থেকে ৫৯৭ কিলোমিটার দূরে। ঢাকার আশপাশে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে, সেগুলোর প্রথম সারির পাঁচটির মধ্যে একটি হলো সিলেটের কাছাকাছি কাছাড় অঞ্চলে ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭.৫ এবং ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে ছিল এর উপকেন্দ্র বা ইপিসেন্টার। অন্যটি ১৮৮৫ সালে ‘বেঙ্গল আর্থ কোয়াক’ বা বেঙ্গল ভূমিকম্প। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার, যার ইপিসেন্টার ছিল ১৭০ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি হয় ১৮৯৭ সালে, যার নাম ছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক। সেটিও ছিল ঢাকা থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরে। কাছাড় ভূমিকম্পের ইপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র ছিল আসামের জয়ন্তিয়া পাহাড়ে।

 

এ ভূমিকম্পের ফলে মনিপুর ও কাছাড় এলাকায় প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। এতে বাংলাদেশের সিলেট জেলাও আক্রান্ত হয় ব্যাপকভাবে। বেঙ্গল ভূমিকম্পের ফলে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রেট আসামে ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭ ছিল এবং এর উপকেন্দ্র ছিল শিলং মালভূমিতে। এই ভূমিকম্পে বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ছাড়াও ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম আক্রান্ত হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে রংপুর, নাটোর, মৌলভীবাজার, সিলেট প্রভৃতি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ভূমিকম্পে শুধু সিলেটেই ৫৪০ জনের প্রাণহানি ঘটে। রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁয় ৩ মিটার প্রস্থ ও এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। ১৭৬২ ও ১৭৮২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল।

 

বড় ভূমিকম্প হলে পুরান ঢাকার যা হবে

ঢাকায় সরাসরি ভূমিকম্প না হলেও ঢাকা থেকে ১০০-১৫০ মাইলের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানলে রাজধানীর ঘনবসতি এলাকা পুরান ঢাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ও অধ্যাপক মেহেদী আহমদ আনসারী ওই এলাকা সমীক্ষা করে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে। কারণ, পুরান ঢাকায় ঘনবসতি এলাকা সবচেয়ে বেশি এবং ঘরবাড়ি বহু বছরের পুরোনো।

 

পুরান ঢাকায় ৩০টির অধিক ঐতিহাসিক দালানকোঠা রয়েছে, যা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া পুরান ঢাকায় প্রায় এক হাজার দালানকোঠা আছে, যা ভূমিকম্পে ভেঙে পড়তে পারে। ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ ছাড়াই পুরান ঢাকায় ৬০ শতাংশ বাড়ি নির্মিত হয়েছে। ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া পুরান ঢাকার রাস্তা এত সরু যে, দমকলের গাড়ি প্রবেশেরও কোনো সুযোগ নেই। অধ্যাপক আনসারীর তথ্য অনুযায়ী ঢাকা নগরীর ঘরবাড়ির মাত্র ৫ শতাংশ তৈরি হয়েছে সুদৃঢ় কংক্রিটে (আরসিসি)। ৩০ শতাংশের কাঠামো প্রকৌশলগত নিয়মনীতি মেনে। আর ২১ শতাংশ ঘরবাড়ি নির্মাণে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এ নগরীর ৫ শতাংশ বাড়ির দেয়াল মাটির তৈরি এবং গ্যালভানাইজড আয়রনের তৈরি ৯ শতাংশ। ৩০ শতাংশ ঘরবাড়ি কাঠ ও বাঁশের তৈরি। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঢাকা মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পড়েছে। তবে রিখটার স্কেলের ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় হলে প্রায় ছয় হাজার আরসিসি কাঠামো ভেঙে যাবে। তাই রাজউককে রাজধানীর ভবনগুলো জরিপ করে সেগুলো কতটুকু মজবুত, কতটুকু নাজুক— তার ভিত্তিতে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে হবে।

 

বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০ থেকে ৩৫টি মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়। মাঝারি ও বড় ধরনের ভূকম্পন হয় কদাচিৎ। এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প এ দেশে অনুভূত হয়েছে বলে অধ্যাপক আনসারীর নিবন্ধন থেকে জানা যায়।

 

প্লেট টেকনিকতত্ত্বে ভূমিকম্প

হিমালয় অঞ্চলের একটি দেশ হিসেবেই বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। বাংলাদেশ ও তার পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে যে ‘ফল্ট’ বা চ্যুতি রয়েছে, এর কারণেই এসব এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর আগেও ড. মনিরুল হক এ প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ অঞ্চলে এসব ‘ফল্ট’ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, তা প্লেট টেকনিকতত্ত্বের সাহায্যে তার বর্ণনা দেন। তার মতে, পৃথিবীর অভ্যন্তর তিন অংশে বিভক্ত। সর্ববহিঃস্থ ১০০ কিলোমিটার থেকে ১৫০ কিলোমিটারের গভীর কঠিন আবরণকে অশ্মমণ্ডল বলে। অশ্মমণ্ডলের ওপরের ভাগ অধিক কঠিন। নিচের দিক কঠিনতত্ত্ব ক্রমেই কম। কারণ ভূপৃষ্ঠ শীতল হলেও ভূগর্ভ এখনো উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে। এই অশ্মমণ্ডলকে কতগুলো প্লেটে ভাগ করা যায়। এই প্লেটগুলো স্থির নয়। একটির সাপেক্ষে অন্যটি এবং পৃথিবীর অক্ষের সাপেক্ষে সর্বদাই চলমান। আগ্নেয়গিরি মণ্ডল, ভূমিকম্প মণ্ডল ও ভূ-আলোড়ন অঞ্চলগুলো প্লেটগুলোর মধ্যভাগ ভূমিকম্প আগ্নেয়গিরি ও ভূ-আন্দোলন থেকে মুক্ত।

 

পৃথিবীতে সাতটি প্রধান ও বহু ক্ষুদ্র প্লেট রয়েছে। প্রধান প্লেটগুলো হচ্ছে— ভারতীয় প্লেট, প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট, আফ্রিকান প্লেট, অ্যান্টারটিক প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট, দক্ষিণ আমেরিকান প্লেট ও উত্তর আমেরিকান প্লেট। ক্ষুদ্র প্লেটগুলোর মধ্যে বার্মা প্লেট, নাজকা প্লেট, চীনা প্লেট, আরবীয় প্লেট, ক্যারিবীয় প্লেট অন্যতম। এ প্লেটগুলো কখনো কখনো পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে নতুন সাগরের সৃষ্টি হয়; আর সমুদ্রতলের আয়তন বৃদ্ধি পায়। কখনো দুটি প্লেটের মধ্যে যদি সংঘর্ষ ঘটে, তবে সৃষ্টি হয় আগ্নেয়গিরি, পর্বতমালা ইত্যাদি। আবার কখনো দুটি প্লেট একটি আরেকটির গা ঘেঁষে গেলে সৃষ্টি হয় ‘ফল্ট’ বা ‘চ্যুতি’। বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এ তিনটি প্লেট হচ্ছে ভারতীয় প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেট। ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে, ভারতীয় প্লেট ক্রমান্বয়ে ইউরেশিয়ান প্লেটে ও বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে হিমালয় পর্বতমালার। তেমনি ভারতীয় প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংঘর্ষে সৃষ্টি হয়েছে আরাকান-আর এইআলার। প্লেটগুলোর এ সংঘর্ষ প্রতিনিয়েই চলছে। এ কারণেই হচ্ছে ভূমিকম্প বা আগ্নেয়াগার।

 

বাংলাদেশের ভূকম্পন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা

বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের ঝুঁকির দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এ মানচিত্রে জোন-৩কে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জোনের দুই কোটি ১০ লাখ মানুষ যে কোনো বড় ভূমিকম্পের শিকার হতে পারে। জোন-২ বলে চিহ্নিত এলাকার অধীনে রয়েছে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। মাঝারি ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ জোনে ভূমিকম্প হলে সাড়ে ছয় লাখ মানুষের জীবন বিপর্যন্ত হতে পারে।

 

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে, জোন-২-এর ভূমিকম্পের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি ঘটবে, তার প্রধানটিই হবে জীর্ণদশা ও অপরিকল্পিত ইমারত নির্মাণের কারণে। অন্যদিকে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় বিনা চিকিৎসা বা উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে অসংখ্য মানুষের প্রাণ ও অঙ্গহানি ঘটবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

 

সাম্প্রতিক জিপিএস গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতীয় প্লেট বছরে ছয় সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বে সরে যাচ্ছে। অন্যদিকে বার্মিজ প্লেট বছরে দুই সেন্টিমিটার করে পশ্চিম দিকে সরে আসছে। ফলে আমাদের উত্তর ও পূর্বে প্লেট বাউন্ডারিতে এবং বাংলাদেশের শিলাস্তরের অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। এই সঞ্চিত শক্তি শিলাস্তরের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করলে ভূ-অভ্যন্তরে ফাটল বা চ্যুতি হয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আমাদের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর প্রচুর ফাটল বা চ্যুতি রয়েছে, যা প্রমাণ করে অতীতে এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে।

 

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা জানান, সিলেটের উত্তরে শিলং মালভূমির পাদদেশে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ‘ডাউকি ফল্ট’ অবস্থিত। এই ডাউকি ফল্টে গত ১০০ বছরে কোনো ভূমিকম্প হয়নি। ডাউকি ফল্ট নিষ্ক্রিয় থাকা আমাদের জন্য মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। এখানে সঞ্চিত শক্তি যে কোনো সময় ভয়াবহ ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারে।

 

আমাদের জন্য আরেকটি উদ্বেগের কারণ হলো বঙ্গোপসাগরে উত্তর আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সিসমিক গ্যাপ, অর্থাৎ এখানে গত ৬০-৭০ বছরেও কোনো ভূমিকম্প হয়নি। এখানেও যে কোনো সময় আট মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হতে পারে এবং সেই ভূমিকম্পটি হতে পারে বঙ্গোপসাগরে। তাই এর ফলে সুনামি সৃষ্টির আশঙ্কা বেশি থাকবে। ডাউকি ফল্টে ভূমিকম্পের ফাটল উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে হওয়ায় সুনামির ঢেউয়ের প্রধান গতিপথ থাকবে উত্তর-পশ্চিম বরাবর। সম্ভাব্য সেই ভূমিকম্পের ফলে বঙ্গোপসাগরে সুনামির সৃষ্টি হলে তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও বাংলাদেশের বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কক্সবাজার, সন্দ্বীপসহ উপকূলের সব অঞ্চলে সরাসরি আঘাত হানবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ডাউকি ফল্ট, পার্বত্য চট্টগ্রামের ফল্ট কিংবা ভারতের মেঘালয়, আসাম, মিজোরাম, মনিপুর— এসব এলাকায় যে কোনো চ্যুতি অবলম্বনে সাত মাত্রার অধিক ভূকম্পন হতে পারে। কিন্তু তেমন দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা একেবারেই অপ্রস্তুত।