Image description

রাজধানীর ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের গলির একটি ছয়তলা ভবনে ২৬ মার্চ ভোরে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপর হামলা চালায় ডাকাতদলের সদস্যরা। তাদের ছেনি ও রেঞ্জের আঘাতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন।

ডাকাতদলের সদস্যদের মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা ছাড়াও অন্তত তিনজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। 

পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, হামলাকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে।

ধর্ষণ ও নিপীড়ন প্রতিরোধের দাবিতে বাম সংগঠনগুলো ১১ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় অভিমুখে স্মারকলিপি দিতে যাচ্ছিল। ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে পৌঁছার পর পুলিশের সঙ্গে তারা বাগ্বিতণ্ডায় জড়ায়। 

 

একপর্যায়ে রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) আবদুল্লাহ আল মামুনের ওপর আক্রমণ চালান এক নারী। পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এ সময় পুলিশের আরও বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন।

কেবল এ দুটি ঘটনাই নয়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনাতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর। কখনো প্রকাশ্য আবার কখনো চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। এগুলো করছে ফ্যাসিবাদের দোসর, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ডাকাত; এমনকি মাদক ব্যবসায়ীরা। উলটোপথে চলাচলে বাধা দেওয়ায় যানবাহনচালকদের হাতেও হামলার শিকার হতে হচ্ছে। হামলা হচ্ছে সমন্বয়ক পরিচয়েও। নারীর হাতেও আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ। 

হকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকরাও হামলা চালাচ্ছে পুলিশের ওপর। থানা হেফাজতে থাকা আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে হামলার মাধ্যমে। মব সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সব মহলের লক্ষ্যবস্তু যেন পুলিশ।

শুধু পুলিশ সদস্য নন, কখনো কখনো আক্রান্ত হচ্ছেন সেনা সদস্যরাও। গ্রেফতার হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে যুবদল নেতার নেতৃত্বে। ডাকাতদের ছাড়িয়ে নিতে থানায় হামলা চালানো হয়েছে পরিবহণ শ্রমিক দল নেতার নেতৃত্বে। ভিকটিম উদ্ধারের নামে উত্তেজিত ছাত্র-জনতার ব্যানারে থানায় হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। থানায় হামলা চালাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করাও।

পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত পুলিশের ওপর শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে সাত মাসে (৫ মার্চ পর্যন্ত) পুলিশের ওপর বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম রেঞ্জে (১৭টি করে)। 

এছাড়া ডিএমপিতে সাত, সিএমপিতে পাঁচ, জিএমপিতে এক, ময়মনসিংহ রেঞ্চে দুই, রাজশাহী রেঞ্জে চার, রংপুর রেঞ্জে ১০, খুলনা রেঞ্জে ছয়, বরিশালে এক এবং সিলেট রেঞ্জে তিনটি হামলা হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের মধ্যে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলায় সর্বোচ্চ চারটি করে ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কক্সবাজার জেলায় ছয়টি, চট্টগ্রাম জেলায় চারটি এবং ফেনীতে তিনটি ঘটনা ঘটেছে। রংপুর রেঞ্জের জেলাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ চারটি হামলার ঘটনা ঘটেছে ঠাকুরগাঁওয়ে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা একের পর এক হামলার শিকার হবেন, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। 

আইনে বলা আছে, সরকারি কাজে বাধাদান একটি অপরাধ। সামনের দিনগুলোয় যারা এ অপরাধে লিপ্ত হবে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক কনস্টেবল আশ্রাফ আলী। এ সময় কে বা কারা তাকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর জখম করে। ২০ নভেম্বর সকালে গেন্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে আটোরিকশাচালকদের ব্যানারে এক-দেড় হাজার লোক রাস্তা অবরোধ করে। একপর্যায়ে অবরোধকারীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে শিক্ষানবিশ সার্জেন্ট আমিনুল ইসলাম গুরুতর আহত হন।

২৪ জানুয়ারি নিউমার্কেট থানার মামলার আসামি ছাত্রদল কর্মী মো. হোসাইন মিথুনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে ছাড়িয়ে নিতে ২৫-৩০ জন লোক থানায় হামলা চালায়। এতে নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) তারিক লতিফসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। এর তিনদিন পর ২৮ জানুয়ারি যাত্রবাড়ীর বিবিরবাগিচা এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী শুটার লিটনকে গ্রেফতার করতে গেলে সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তাদের রামদার কোপে এএসআই এনামুল হকসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন।

চট্টগ্রামের খুলশী থানা এলাকায় গত বছর ২৭ আগস্ট এসএ গ্রুপের এমডির গাড়িচালক মহিউদ্দিন উলটোপথে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল সোহরাব হোসেন তাকে সিগন্যাল দেন। এ সময় হামলা চালিয়ে তার নাক ভেঙে দেয় গাড়িচালক মহিউদ্দিন।

ইসকন নেতা শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় তার সমর্থকরা ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ভাঙচুর চালান। এতে বাধা দেওয়ায় পুলিশের ওপর হামলা হয়। ওই ঘটনায় ১৩ পুলিশ সদস্য আহত হন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সিএমপি ডবলমুরিং এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানের সময় মাদক ব্যবসায়ীর ছুরিকাঘাতে দুই এসআই আহত হন। এর দুইদিন পর ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে পতেঙ্গা সি বিচ এলাকায় মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীরা এসআই ইউসুফ আলীকে মারধর করে ওয়াকিটকি, মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়।

জানা যায়, গত বছর ৩১ আগস্ট রাতে টঙ্গী পূর্ব থানার দীঘিরপাড় এলাকায় যুবলীগ নেতা সাত্তার মোল্লার দীঘিতে মাছ ধরতে যায় দুই-তিনশ দুষ্কৃতকারী। তাদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা, চাকু, ছিনিসহ দেশীয় অস্ত্র। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপর চড়াও হয় দুষ্কৃতকারীরা। আওয়ামী লীগের মিছিলে বাধা দেওয়ায় ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ সদরের গোপীনাথপুর এলাকায় সেনাবাহিনীর ওপর হামলা হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর জিপে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর দুইজন সদস্য গুরুতর আহন হন। গত বছর ৩০ নভেম্বর গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকার নিয়ারচালা গ্রাম থেকে ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি রাজু মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। খবর পেয়ে একই ইউনিয়ন যুবদল সাধারণ সম্পাদক মামুন শিকদারের নেতৃত্বে ১০০-১৫০ লোক হামলা চালিয়ে রাজুকে ছিনিয়ে নেন। ডাকাতির মামলায় গ্রেফতার আসামিদের ছিনিয়ে নিতে গত ৩০ ডিসেম্বর মাধবদী থানায় হামলা চালানো হয় পরিবহণ শ্রমিক দল সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান আশিকের নেতৃত্বে। ১২ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থানায় হামলা চালায় উত্তেজিত ছাত্র-জনতা। এতে ১৬ পুলিশ সদস্য আহত হন। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আসামিকে ছাড়িয়ে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাসুম বিল্লার নেতৃত্বে ২৩ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের নকলা থানায় হামলা হয়। এছাড়া গত সাত মাসে দেশের বিভিন্ন জেলার অর্ধশতাধিক স্থানে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

২০ মার্চ রাতে মৌলভীবাজারের রাজনগর মুন্সিবাজার ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) অভিযানে যায় ডিবি পুলিশ। এ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশের ওপর হামলা হয়। এতে কনস্টেবল মেহেদী হাসান সৌরভ ও তমাল হোসেন রায়হান আহত হন। ২৩ মার্চ ঢাকার আশুলিয়ায় সড়ক ও জনপথের জমি এবং ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়।

এ সময় পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বকেয়া বেতনের দাবিতে তোপখানা রোডের শ্রম অধিদপ্তরের ভবন অবরোধ করতে এসে গত ২৫ মার্চ পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে গার্মেন্ট শ্রমিকরা। ১৮ মার্চ ছয় বছরের এক কিশোরকে ধর্ষণের অভিযোগে ১৬ বছর বয়সি এক কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশের গাড়িতে নেওয়া হচ্ছিল খিলক্ষেত থানায়। এ সময় শতাধিক লোক অতর্কিতভাবে হামলা চালায় পুলিশের ওপর। ভাঙচুর করে গাড়ি। এর আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানার একটি টহল দল কাওরান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ী শাহীন আলমকে গ্রেফতার করে।

এ সময় অন্য মাদক কারবারিরা দেশীয় অস্ত্র চাপাতি ও ছুরি দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করে আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ১৬ মার্চ রাজশাহীর চারঘাটে মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হন আবু হানিফ নামে এক পুলিশ সদস্য। ২১ জানুয়ারি জুয়ার আসরে অভিযান চালানোর সময় ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন বাজার এলাকায় হামলার শিকার হয় ফরিদপুর জেলা ডিবি পুলিশের একটি দল। ৯ মার্চ দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার ডাকবাংলো এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য শাহীন হোসেনের ওপর সমন্বয়ক পরিচয়ে হামলার ঘটনা ঘটে।

১০ মার্চ ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের দুই সদস্য আহত হন। ২ ফেব্রুয়ারি গাপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় লিফলেট বিতরণকালে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে আটক করলে পুলিশের ওপর হামলা করে দলটির নেতাকর্মীরা। এতে ৫ পুলিশ সদস্য আহত হন।

৪ মার্চ রাতে ভোলার বোরহানউদ্দিনে এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় হামলার ঘটনা ঘটে। এতে এক এএসআই আহত হন। চাঁদাবাজিসংক্রান্ত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে ঢাকার পূর্বাচল তিনশ ফুট সড়কে ৫ মার্চ পুলিশের ওপর হামলা চালায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকরা। ১৯ মার্চ সাভারে আসামি ধরতে গিয়ে হামলার শিকার হন তিন পুলিশ সদস্য। এ সময় ভাঙচুর করা হয় পুলিশের যানবাহন।