Image description

জারা-সার্জিস ড্রামা আর বিপ্লবীরা এখন যেভাবে পঁচে যাচ্ছে, ক্ষমতার কাড়াকাড়ি, টাকা পয়সা দায়িত্ব নিয়ে হুড়াহুড়ি, 
এরমধ্যে জুলাই আহতদের লিস্ট নিয়ে দুইনাম্বারী, জুলাই শহীদ-আহতদের নিয়ে কুটনামী প্লাস এরমধ্যেই স্ক্যামবাজী, 
ইত্যাদি ইত্যাদি দেখতে দেখতে প্রায়ই আমার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমার স্মৃতিতে সব আবছা আবছা। কিন্তু বড় হতে হতে এই ঘটনা সবার মুখে শুনে শুনে জেনেছি কী ঘটেছিলো।  


১৯৯১ সালের বন্যার রাতের পরদিন ভোর। আম্মু কাঁদছে ঢুকরে ঢুকরে। (আম্মুর সেই কান্নার দৃশ্য মনে আছে আমার)। 
হাসিনা ফুপু আম্মুর ফেভারিট ননদ ছিলো। ফুপু, ফুপা, বাচ্চাকাচ্চা সবাই বন্যায় মরে গেছে শুধু একটা মেয়ে ছাড়া (আমাদের সেই ফুপাতো বোন তারপর থেকে আমাদের বাসাতেই বিয়ে পর্যন্ত ছিলো)। 
বাকী সব ফুপুদের বাড়ির ছিটাফোঁটাও নাই। 


দাদু গাছের পাতা দিয়ে দিয়ে বানানো ঝুপড়ির ভিতর নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন কারণ ঘরবাড়ি কিছুই তো নাই, মিডিয়ার মানুষ আসছে, পর্দানশীন দাদু মানুষের সামনে আসবেন না (এটা আমি শুনেছি একজন আংকল'র কাছে)। 
তখন সৌদি এম্বেসেডর আব্বুকে খুব স্নেহ করতেন। সৌদি থেকে দ্রুত এসে পৌঁছালো সাহায্য আমাদের গ্রামে। আব্বু সমস্ত মানুষদের লিস্ট দিলেন গ্রামের। কিন্তু নিজের বোনদের আর মা'র নাম দিলেন না লিস্টে (এটা জেনেছি আম্মুর কাছে)।   


ফুপুরা প্রচণ্ড অসন্তুষ্ট হলেন আব্বুর উপর। দাদু আব্বুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। দাদুর কথা ছিলো -  'তোমার মা হিসেবে না, গ্রামের আর দশটা মানুষের মত মানুষ হিসেবে কেনো আমার নাম দিলা না? আমি কোথায় সাহায্য পাবো?' 
জামাতের আঙ্কলরা আব্বুকে বললেন- তাহের ভাই, আপনার আম্মা আর বোনেরা আর দশজন মানুষ যে সাহায্য পাচ্ছে সেই সাহায্যও কেনো নিতে পারবেনা?! 
(এগুলো দাদু নিজে বলেছিলেন আমাকে)।  


কিন্তু কোনো লজিক আব্বুকে কনভিন্স করতে পারেনি। আব্বুর সামর্থ্য ছিলোনা নিজের সব বোনদেরকে আর মা-কে ঘর তুলে দেয়ার অন্ততঃ মাথাটা গোঁজার জন্য; 
অথচ অন্যদিকে সৌদি সাহায্য নিয়ে মোটামুটি আশেপাশের সবাই আগে যার ছনের ঘর ছিলো সেও দেয়াল তোলা ইটের ঘর বানিয়ে নিয়েছে!  
দাদু সারাজীবন সেই দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আফসোস করে করে আমাদেরকে শোনাতেন পুরো ঘটনা। 


এটা তো একটা ঘটনা মাত্র! 
আরেকবার আমার মনে আছে- সৌদি কুরবানীর গোশতের সাথে খুব মজার মজার খেঁজুর এসেছিলো! অমন টসটসে এত বড় বড় খেঁজুর আমি জীবনে দেখিনি! 
আমরা ভাইবোনরা খুশীতে ভাবছি- সবার জন্য যখন ভাগ হবে, আমাদের বাসার জন্যও নিশ্চয়ই একটা ভাগ থাকবে। 
ওমা! 


একটু পরেই আব্বুর অফিস থেকে ফোন আসলো- ঐ গোশত আর খেঁজুর অফিসে না গিয়ে কেনো আব্বুর বাসায় এসেছে আব্বু বেশ রেগে আছেন! সাথে সাথে বাসা থেকে সব অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো ওখান থেকেই ভাগ হবে। আব্বুদের অফিসের সবাই ভাগ পেলো, শুধু আব্বুর বাসায় আব্বু কোনো ভাগ আসতে দিলেন না। 


অফিসের একজন স্টাফ লুকিয়ে উনার নিজের ভাগ থেকে একটু দিয়ে গেলেন আম্মুকে, বলে গেলেন- ভাবী, ফারজানারা ছোট ছোট, ওদেরওতো খেতে ইচ্ছে করে! 
আমার মনে আছে, আম্মু কিছু বলার আগেই আমি প্যাকেট খুলে দ্রুত একটা খেঁজুর মুখে পুরে নিয়েছিলাম! 
ভয় পাচ্ছিলাম আবার আংকল'র আনা পোটলাটাও যদি আম্মুও ফেরত দিয়ে দেয়!! 


আরেকবার, দৈনিক কর্ণফুলী আর আইআইউসি'র জন্য ফাইনানশিয়াল হেল্প কালেকশান করতে মিডল ইষ্ট ট্যুর শেষ করে আব্বু ফিরেছে। বিদেশ থেকে আসলে আব্বু আমার জন্য একটা বই আনতো। অন্য ভাইবোনদের জন্য ছোট খাটো কিছু আনতো কিনা মনে নেই। 
এখন বুঝি- ঐ বইটা কিনতেও নিশ্চয়ই আব্বুর খুব টাকাপয়সার হিসাব করতে হতো। 


সেবার আব্বু আসার পর পর বাসায় ফোন আসলো আব্বুর অফিস থেকে- আব্বু জানেনা আব্বুর সাথের আংকলদের সাথে একটা সুইটকেস ভর্তি গিফট পাঠিয়ে দিয়েছে মিডলইষ্টের জামাতের আংকল আন্টিরা। আব্বু আনতে অস্বীকার করেছে বলে উনারা অন্য আংকলদের সাথে আব্বু না জানে মত পাঠিয়ে দিয়েছে আব্বুর পরিবারের জন্য। 
বাসায় সেই সুইটকেস আসলো। আমরা উত্তেজনায় সেই সুইটকেস খুলে ফেললাম! 


আমার মনে আছে- আমার কাছে মনে হচ্ছিলো আমরা যেন কোনো দূর্লভ যাদুর সিন্দুক খুলেছি! জীবনে দেখিনি এমন সব লোভনীয় গিফট! 
কিন্তু আম্মু আমাদেরকে টাচ্‌ করতে দিলো না। বললো- আব্বু আসুক আগে, আব্বু এসে অনুমতি দিলে তারপর নিতে পারবো। 
অধীর আগ্রহে আমরা ভাইবোনরা বসে আছি। 


আব্বু দুপুরে অফিস থেকে আসলেন। 
এসে সুইটকেসের কথা শুনলেন। 
নিজ হাতে সেই সুইটকেস বন্ধ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন আমরা কেউ অলরেডী কিছু নিয়েছি কিনা। 
ভীষণ মন খারাপ নিয়ে আমরা জানালাম কেউই কিছু নেইনি। 
আব্বু অফিস থেকে স্টাফকে ফোন করে ডাকলেন। তারপর সেই সুইটকেস চলে গেলো অফিসে। 
অফিসে স্টাফদের ফ্যামিলির মধ্যে সেই গিফট বণ্টন করে দেয়া হলো। 


আমরা কিছুই পেলাম না। 
আব্বু শুধু বললেন- এই গিফট নেয়া আমাদের জন্য জায়েজ হবে না। কারণ এটা সংগঠনের টাকায় যাওয়া ট্যুর। আব্বুর নিজের ব্যক্তিগত ট্যুর না। তাই আব্বু ব্যক্তিগত গিফট নিলে গুনাহ হবে। 


এগুলো তো শুধু আব্বুর ঘটনা। আব্বুদের সময়ে এইরকম ঘটনা ছিলো জামাত নেতাদের ঘরে ঘরে। একদম লিটারালি অলমোষ্ট সব জামাত নেতাদের ঘরে ঘরে এই কাহিনী ছিলো।   
আমি এই রোযায় কী ভাবছি জানেন? 


আল্লাহ্‌ চাইলে তো অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায়। এখনের জামাত যদি আমার ছোটবেলার দেখা জামাতের মত হয়ে যেতো! কেমন হতো? বাংলাদেশ তখন অবাক হয়ে দেখতো- ক্ষমতার জন্য কাড়াকাড়ি আর টাকা পয়সা নিয়ে হুড়াহুড়ি দূরের কথা- 


পুরো দেশ অবাক হয়ে দেখতো - সেই সাহাবাদের যুগের মত কিছু অসম্ভব রকম আইডিয়ালিষ্টিক মানুষ নিজে তো নিজে, নিজের পরিবারকেও এক চিমটি ক্ষমতা বা টাকা ছুঁতে দেয় না! 
অবাক হয়ে দেখতো- এই সময়ে, এই পঁচে গলে যাওয়া সময়েও আইডিয়ালিষ্ট মানুষ হওয়া সম্ভব! আইডিয়ালিষ্ট নেতা নেত্রী হওয়া সম্ভব!  
ইশ! 


ছোটবেলায় বড় হতে হতে যা দেখেছি- ইশ, তার ছিটেফোঁটাও যদি এখন থাকতো বাংলাদেশের নেতানেত্রীদের মধ্যে!! ইশ!
---- 
নাহিদ, মাহফুয, আসিফ, সার্জিস, হাসনাত, সোহেল, উমামা, নুসরাত - ভাইরা, আপুরা, আপনারা তো আমাদেরকে এমন একটা বাংলাদেশেরই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যে বাংলাদেশে আমরা এমন আইডিয়ালিষ্ট নেতৃত্ব পাবো! 
আমাদের সেই স্বপ্ন কি সত্যি হবে না?

লেখক ঃ ফারজানা মাহবুবা