
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ। একই সঙ্গে তারা বড় রপ্তানিকারক ও দ্বিতীয় আমদানিকারক। ১৪১ কোটি মানুষের এই বাজার বাংলাদেশের জন্য বিপুল সম্ভাবনাময়। কিন্তু বাংলাদেশকে শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও চীনে রপ্তানি বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ। উল্টো বেড়েই চলেছে বাণিজ্য ঘাটতি। প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফরে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশে চীনের প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে। এটা ১০ গুণ বাড়ানো যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের আমদানি বাজেটের এক শতাংশও যদি বাংলাদেশ থেকে যায়, তাহলেও বাংলাদেশ বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করতে পারবে। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে প্রয়োজন রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ। রপ্তানিতে সক্ষমতা বাড়াতে হবে, চীনা বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কমদামি পণ্য নিয়ে চীনে খুব একটা রপ্তানি বাড়বে না। কারণ তারা নিজেরাই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। এ জন্য উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি বাড়িয়ে দেশটিতে আয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীন। ২০২২ সালে এসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যকে দেওয়া হয় এই সুবিধা। ২০২৩ সালে যুক্ত হয় আরো ৩৮৩টি পণ্য। ২০২৩ সালের আগস্টে নতুন করে ১ শতাংশ আর ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শতভাগ পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীনা সরকার।
শতভাগ শুল্ক ছাড় পেয়েও কেন চীনে রপ্তানি বাড়ছে না—জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনের শিল্প খাত অনেক বড়। তারা নিজেদের উৎপাদনসক্ষমতা দিয়ে বেশির ভাগ চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে।
ছোট ও মাঝারি শ্রেণির পণ্যে তাদের সক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তার পরও আমরা একই ধরনের পণ্যই রপ্তানি করছি। সে কারণে চীনে রপ্তানি বাড়াতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। যদি আমরা উচ্চমানের পণ্য রপ্তানিতে যেতাম, তাহলে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি আরো বাড়ত।’
চীনের আমদানীকৃত পোশাকের বাজার ১০ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া দেশটির অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজার ৩৩০ বিলিয়ন ডলার। চীনে শ্রমিকদের মজুরিসহ পণ্য উৎপাদনের আনুষঙ্গিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। চীনারা কমদামি পণ্য উৎপাদন করলেও নিজেদের ব্যবহারের জন্য তারা উচ্চমানের পণ্য খোঁজে। সে ক্ষেত্রে তাদের উচ্চমানের পণ্যের একটি বিকল্প হতে পারে বাংলাদেশ। চীনে রপ্তানি বাড়াতে ভ্যালু অ্যাডেট পণ্য উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন বিজিএমইএর এই সাবেক পরিচালক।
মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, আমাদের রপ্তানিও আমদানিনির্ভর। অর্থাৎ আমরা যেসব পণ্য রপ্তানি করি তার কাঁচামালের বেশির ভাগই চীন থেকে আমদানি করি। ফলে চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি থাকবেই। তবে সেটা অবশ্যই কমানোর চেষ্টা করতে হবে। আমরা দেশেই কাঁচামাল উৎপাদন করে চীন থেকে আমদানি কমাতে পারি। অন্যদিকে উচ্চমানের পণ্য পাঠিয়ে রপ্তানি আয় বাড়াতে পারি, তাহলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে।
বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্রের (আইটিসি) তথ্য অনুযায়ী চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০২৪ সালে ৯৭৫৩.৫৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৪৫১.৯২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। যা চীনের মোট আমদানির মাত্র ৪.৬৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৪.৩২ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৪.০৩ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল এক হাজার ৫২৩ কোটি ৯৫ লাখ বা ১৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। একক দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গেই ঘাটতি এক হাজার ৭১৪ কোটি ৯২ লাখ বা ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থাৎ সামগ্রিক ঘাটতির চেয়ে দুই বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি ঘাটতি এশিয়ার এই দেশটির সঙ্গে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ৬৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। আগের অর্থবছরে তা ছিল ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।
একই সঙ্গে কমেছে দেশটির বিনিয়োগও। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যানুসারে, সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ এসেছে ৯ কোটি ৩২ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ছিল ১১৫ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশটির মোট বিনিয়োগ ১২৫ কোটি ৬২ লাখ ডলার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৪ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৪০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। বিপরীতে চীন দুই হাজার ২৯০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। বাংলাদেশ প্রধানত তৈরি পোশাক, পাট, পাটজাত পণ্য, মাছ ও চামড়া রপ্তানি করে থাকে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ আমদানি করে মূলত মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল। বৈশ্বিক বাণিজ্য সংস্থা ডব্লিউটিওর তথ্যমতে, ২০২২ সালে দেশটি ২.৭২ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২৭ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের বাজারে বড় আকারে প্রবেশ করতে হলে তৈরি পোশাক ছাড়াও বাংলাদেশকে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরটি বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে খুব আশা তৈরি করেছে। বর্তমানে যে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলছে, তাতে আমাদের জন্য নতুন এভিনিউ তৈরি করা সময়ের প্রয়োজনেই দরকার। চীন দুই দশক ধরে বাংলাদেশের কৃষিপ্রধান দেশ থেকে শিল্পপ্রধান দেশে রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। সামনের দিনের যে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ আসছে এশিয়ার দিকে, তাতে চীনের সঙ্গে আমাদের নিবিড় এবং গভীর ব্যাবসায়িক সম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। এই সফরটি আগামীতে ব্যাবসায়িক দিকনির্দেশনায় বড় ভূমিকা রাখবে।’
তিনি আরো বলেন, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে যেসব দেশ কারখানা স্থানান্তর করবে, সেগুলো যাতে বাংলাদেশে আসে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার এবারের চীন সফরে এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রেড বাস্কেটটিকে আরো বৈচিত্র্যময় করতে হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে দেশের উৎপাদন ক্ষমতা, যাতে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হলে, সেই বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করে রপ্তানি পণ্য চীনের বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। চীন আমদানি করে—এমন পণ্যের উৎপাদনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও জোর দিতে হবে।’