Image description
 

বাংলাদেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একধরনের উগ্রবাদ ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টার প্রবণতা দেখা গেছে। এই গোষ্ঠিটি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুযোগ নিতে চাইছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা নিজেদের এই পরিবর্তনের অংশীদার দাবি করে তাদের চিন্তা এবং মতবাদ চাপিয়ে দিতে চাইছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা “তৌহিদি জনতা” ব্যানার ব্যবহার করছেন।

গত ১০ মার্চ সাভারে টিকটকার হৃদয় খানকে পুলিশ আটক করে। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন সেজে লাঠি হাতে নারীদের বোরখা ও হিজাব পরার উপদেশের প্রাঙ্ক ডিডিও ছেড়েছিলেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাকে যখন পুলিশ আটকের জন্য খুঁজছিল তখন তিনি আরেকটি ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছাড়েন। সেখানে তিনি নিজেকে জুলাই আন্দোলনের একজন হিসাবে দাবি করে তার কাজকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “পর্দা করার উপদেশ দিয়ে আমি কোনো ভুল করিনি।”

মানবাধিকার কর্মী নূর খান তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কয়েকদিন আগে আমি লালমাটিয়া এলাকায় দেখলাম একজন সঙ সেজে মানুষকে হ্যান্ড মাইকে মাস্ক পরার কথা বলছে। নারীদের ওড়না ছাড়া বাইরে আসতে নিষেধ করছে। আমি তো একজনকে দেখেছি। এরকম আরও অনেকে তৎপর বলে আমার কাছে খবর আছে। তার মানে হচ্ছে উগ্রবাদীরা কৌশলে তাদের অবস্থান তৈরি করতে চায়, নারীবিদ্বেষ ছড়ায়।”

তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে পর্দার নামে নারীর শরীর বর্ণনা করে নারীবিদ্বেষ ছাড়ানো হচ্ছে। তা সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জোর করে তারা তাদের মতো ইসলামীকরণের চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকার এখানে নির্বিকার। তাদের শক্ত হাতে দমন করা দরকার।”

বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কিছু লোক আছে ইসলামের নামে নারীদের নিয়ে ওয়াজের নামে কুরুচিপূর্ণ কথা বলেন। তারা ইসলামের জন্য ভালো কিছু করছেন না। সরকারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা তাও দেখা দরকার।”

তিনি বলেন, “ইসলামে যে পর্দার বিধান আছে সেটা ইসলাম যেভাবে বলে সেভাবে অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করা যাবে। কিন্তু রাস্তাঘাটে এটা নিয়ে যা করা হচ্ছে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। কাউকে ওড়না পরানো, বোরখা পড়ানো-এই মোরাল পুলিশিং-এর কাজ কেউ কাউকে দেয়নি। মোরাল পুলিশিং আমাদের কাজ নয়। কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কোনো কোনো ওয়াজের পুরাটাই নারীকে নিয়ে, কিন্তু দর্শক শ্রোতা পুরুষ। পুরুষ যা শুনতে চায় তা বলা হয়। ফলে জমজমাট ব্যবসা হয়।”
বাংলাদেশে একসময় এই নারীবিরোধী ওয়াজ নিয়ন্ত্রণের সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে বৈঠকও হয়েছিল আলেমদের নিয়ে। কিন্তু প্রভাবশালী কিছু ওয়াজেরিনের কারণে তা সফল হয়নি। আর ওই গোষ্ঠীটি চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মাওলানা আনিসুজ্জামানের সঙ্গে ডয়চে ভেলে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। কিন্তু তখন তিনি ওই উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন।

প্রতিবাদকারীরা বিপদে

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে ওড়না ঠিক করার কথা বলে হেনস্তা করায় বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কর্মচারী আসিফ অর্ণবকে অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করে পুলিশ। কিন্তু তাকে ছাড়িয়ে নিতে রাতে শাহবাগ থানা ঘেরাও করে তৌহিদী জনতা। থানা তাকে না ছাড়লেও তাকে আদালত থেকে জামিন দেওয়া হয়। জামিনের পর তৌহিদি জনতা তাকে ফুলের মালা আর পাগড়ি আর হাতে পবিত্র গ্রন্থ দিয়ে বরণ করে নেয়। ছাত্রীটিকে সমঝোতায় বাধ্য করে ওই জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। ওই শিক্ষার্থী এখন আর বাইরেও বের হতে পারছেন না। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। তার এক বান্ধবী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ওই ঘটনার পর সে অনেকটা ট্রমায় ভুগছে। ভয়ে হল থেকে বাইরেও বের হতে চায় না। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।” বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও ঐ কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “আমরা দেখলাম ওই ইভটিজারকে গলায় ফুলের মালা, মাথায় পাগড়ি আর হাতে পবিত্র কোরআন শরিফ দিয়ে বের করে আনা হলো। এটাও একটা প্রচারণা যে তুমি নারীর পোশাক নিয়ে বলো। রাস্তায় গিয়ে ড্রেসের কথা বলো, টিজ করো৷ পরে কিছু হলে ধর্মের দোহাই দেবে।”

গত ১ মার্চ মোহাম্মদপুরে একটি টি স্টলে প্রকাশ্যে ধূমপানের অজুহাত তুলে নারীবিদ্বেষীরা দুই তরুণীর ওপর আক্রমণ করলেও পুলিশ ওই মবের পক্ষেই অবস্থান নেয়। দুই তরুণীকে থানায় নিয়ে যায়। দুই সপ্তাহ পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে ওই মবের হোতাকে আটক করা হয়।

দুই তরুণীকে হেনস্তার প্রতিবাদে শাহবাগে যারা প্রতিবাদ করেছিলো তাদের ছবিকে নানা ট্যাগ দিয়ে আবার ওই গোষ্ঠী সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। তাদের একজন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এখন আমি বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছি না। আমরা ছবি যেভাবে কুরুচিপূর্ণভাবে ছড়ানো হয়েছে তাতে আমি আর স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারব কি-না জানি না।”
মাগুরায় শিশু ধর্ষণের প্রতিবাদে শাহবাগে যারা প্রতিবাদ করেন তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার মামলা হয়েছে। তাদের ছবিও নানাভাবে ফেসবুকে ছাড়ানো হয়েছে।

আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “এইসব কারণে সমাজে ও রাষ্ট্রে পোটেনশিয়াল রেপিস্ট তৈরি হচ্ছে। তারা দেখছে নারীকে হেনস্তা করলে যৌন নিগ্রহ করলে নন্দিত হওয়া যায়। বাহবা পাওয়া যায়। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে নারী তো যৌন নিগ্রহের শিকার হবেই। ওয়াজে নারীকে যে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে তো রাস্তায় নেমে নারীকে ওড়না পরাতে বোরখা পরাতে উৎসাহিত হবে।”
‘পরিবর্তনের প্রথম শিকার হন নারীরা'

বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে অভিনব পন্থায় হেনস্তা করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় কেউ একজন তার ফোন নম্বর চাইলে তিনি যখন তাকে ফোন নম্বর বলেন তখন পাশ থেকে কেউ একজন সেটা ভিডিও করে নেয়। পরে সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর তারপরই অসংখ্য ফোন কল আসতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তিনি সেই ফোন নম্বর পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।

রুমিন ফারাহানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমাদের সমাজব্যবস্থা যে কেবল পুরুষতান্ত্রিক তাই নয়, নারীবিদ্বেষী একটা সমাজ ব্যবস্থা। তাই যে-কোনো পরিবর্তনের প্রথম শিকার হন নারীরা, যে-কোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এটা ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে হতে পারে। ফলে এই সমাজে নারীর প্রতি যা ঘটছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে পরিবর্তনের আওয়াজ যদি আমরা এখনই তা তুলি আমরা তাহলে পরিস্থিতি আরও অসহনীয় হয়ে উঠবে। এরইমধ্যে আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, “নারী এগিয়ে যাচ্ছে৷ এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনেকেই মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা কখনো ধর্মের নামে অথবা অন্য কোনো উপায়ে দমিয়ে রাখতে চায়।”

তিনি আরও বলেন, “পোশাক কখনো ধর্ষণের কারণ হতে পারে না। কুমিল্লার তনু তো হিজাব পরতেন। তিনি কেন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। শিশুরা কেন ধর্ষণের শিকার হয়। ছেলে শিশুরা কেন বলাৎকারের শিকার হয়?”
মালেক বানু বলেন, “নারীর প্রতি সহিংসতার বিচারহীনতাই হচ্ছে এটা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ। একইসঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজেই রয়েছে এর সক্রিয় উপাদান। পরিবারের মধ্যে এবং পরিচিতজনের মাধ্যমেই নারী সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার শিকার হন। আর বিচার ও পুলিশি তদন্তের দুর্বলতার কারণে মাত্র তিন শতাংশ নারী শিশু নির্যাতন মামলায় আসামিরা শাস্তি পান।”
ড. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা মনে করেন, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন সহিংসতা বন্ধ করতে আইনই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মনোজাগতিক পরিবর্তন।

পরিসংখ্যান

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০২৪ সালে সারাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৫২৩ জন নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ২৭৮ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৭৪ জন। ২০২৩ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৫০৭ জন নারী।

অন্যদিকে ২০২৪ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৭৭ জন নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৩৬ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন ৭ নারী।

ওই বছর সারাদেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় একজনকে।
যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৬৬ জন নারী। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুই জন নারী ও খুন হয়েছেন তিনজন নারী।

এ বছরের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে ৮৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চারজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩৫ জন।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১১ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ছয় হাজার ৩০৫ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। যাদের ধর্ষণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে, যা মোট ঘটনার ৫৫% বেশি। অন্তত ৫০ জন ভয়াবহ সহিংসতার ট্রমা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। গত পাঁচ বছরে দুই হাজার ৬২৪ জন নারী ও মেয়ে শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

আইন সংশোধন

পরিস্থিতি সামাল দিতে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ধর্ষণ মামলার তদন্তে ১৫ দিন এবং বিচারের জন্য তিন মাস সময় বেধে দিয়ে আইন সংশোধন অনুমোদন করা হয়েছে। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের শাস্তি করা হয়েছে সাত বছরের কারাদণ্ড। আর মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহাল আছে।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে কোনো লাভ নেই। প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিচারক ও আদালত। আর সময় বেধে দিলেও আপিল আদালতে তো আর সময় বেধে দেয়া যায় না।”

মালেকা বানুর ভাষ্য, আইন পর্যাপ্ত আছে। প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ এবং বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।