
পবিত্র রমজানে ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের দাম পাইকারিতে গত বছরের তুলনায় অনেকটা কম হলেও খুচরা বাজারে তেমন প্রভাব নেই। এখনো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
শুল্কছাড়ের কারণে এবার ব্যাপক আমদানি হয়েছে। অগ্রিম কর অব্যাহতি, কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে শুল্কায়ন করায় এবার খেজুরের দাম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে বলে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান। এর পরও খুচরা বাজারে খেজুরের দাম চড়া। পাইকারি বাজারের তুলনায় খুচরা বাজারে মান ও প্রকারভেদে প্রতি কেজি খেজুরে ১০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত পার্থক্য দেখা গেছে।
সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, আমদানি ব্যয় কম হওয়ায় বাজারে খেজুরের দাম কম থাকবে। কিন্তু আমদানি বৃদ্ধি এবং সরকারের শুল্ক কমানোর সুবিধা পাচ্ছে না ভোক্তারা।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে আজওয়া, মারিয়াম, আমবর, মসদুল, সাফাবি, সুপরি, মাসরুখ, মাবরুম, জিহাদি, দাব্বাস, নাগাল, লুলু, সাইয়িদি, ফরিদি, রশিদি, কুদরি, মেডজুল, সুকারিসহ নানা জাতের ও নামের খেজুর রয়েছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক বছরের তুলনায় এবার খেজুরের দাম ‘সহনীয়’ থাকার কারণ শুল্কছাড়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম কম থাকা। এ ছাড়া এ বছর আমদানিকারকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় খেজুরের বাজার অস্থিতিশীল করার কোনো সুযোগ ছিল না। খুচরা বিক্রেতাদের লাভের আকাঙ্ক্ষা বেশি থাকায় তাঁরা কেনা দামের চেয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ লাভ ছাড়া খেজুর বিক্রি করছেন না। এতে ভোক্তারা সরকারের শুল্কছাড়ের সুফল পাচ্ছে না।
গত বুধবার ও মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরায় প্রতি কেজি আজওয়া খেজুর মানভেদে এক হাজার থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা, দাব্বাস খেজুর ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, বরই খেজুর ৪৬০ থেকে ৫০০ টাকা, জিহাদি খেজুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, সুকারি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, মারিয়াম ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, ছড়া খেজুর মানভেদে ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, মেডজুল মানভেদে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বাদামতলীর খেজুরের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, পাইকারি পর্যায়ে পাঁচ কেজির আজওয়া খেজুরের কার্টন তিন-চার হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সেই হিসাবে প্রতি কেজি পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার সরকার খেজুরে ভ্যাট ও শুল্ক সুবিধা দেওয়ায় ব্যাপক আমদানি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশের বেশি আমদানি হয়েছে। খেজুরের দামও কমেছে ৩৫ শতাংশের মতো। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা দাম কমিয়ে বিক্রি করছে না বলে আমাদের কাছেও অভিযোগ আছে। তাই আমাদের পরিকল্পনা আছে আগামী দিনে বিভিন্ন এলাকায় ট্রাক সেলের মতো খুচরায় বিক্রির ব্যবস্থা করব। এতে খুচরা বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। কেউ চাইলে বাড়তি দরে বিক্রি করতে পারবে না। রোজার আগে আগে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে একটা মেলার আয়োজন করারও পরিকল্পনা রয়েছে। এখান থেকে ক্রেতারা ন্যায্য দামে খেজুর কিনতে পারবে।’
বাদামতলীর মেসার্স মোল্লা ফ্রেশ ফ্রুটস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আল আমিন মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি খেজুর আমদানি হয়েছে। এতে আমাদের লাভ তো দূরের কথা, লোকসান দিয়েও কিছু খেজুর বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা বন্দরে পাইকারিতে কেজিতে দু-তিন টাকা লাভে মাল ছেড়ে দিচ্ছি। অথচ খুচরা বাজারে এক কেজি খেজুর বিক্রি করে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত লাভ করছে। এই বিষয়টি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দেখা উচিত। অভিযান চালালে খুচরা বিক্রেতারা দাম কমাবে।’
রাজধানীর বাড্ডার খুচরা খেজুর বিক্রেতা মো. আব্দুল খালেক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিবছর রোজা উপলক্ষে খেজুরের দাম বেড়ে যায়। এবার সেটি হয়নি। বরং রোজার আগের সময়ের তুলনায় দাম কিছুটা কমেছে। রোজার শেষ দিকে আরো কমবে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছর খেজুর আমদানিতে যুক্ত ছিলেন ৫৮ জন। এবার তা অন্তত ১৫৮ জনে দাঁড়িয়েছে। এনবিআরের তথ্য অনুসারে, দেশে আমদানি করা খেজুরের ৮০ শতাংশ আনা হয় রোজার তিন মাস আগে। সে অনুযায়ী এবার ডিসেম্বরের শুরু থেকে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ আড়াই গুণ বেশি খেজুর আমদানি করা হয়েছে। এবার তিন মাসে দেশে খেজুর এসেছে ৪৬ হাজার ১২৩ মেট্রিক টন। এর আর্থিক মূল্য ৮৩৩ কোটি টাকা। গত মৌসুমে এর পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮২৬ মেট্রিক টন, যার আর্থিক মূল্য ছিল ৪০১ কোটি টাকা। পাশাপাশি এ দফায় খেজুর আমদানিতে সরকারের রাজস্ব এসেছে ৩২১ কোটি টাকা। গত মৌসুমের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২১২ কোটি টাকা। এ হিসাবে এবার খেজুর আমদানি থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১০৯ কোটি টাকার বেশি।
আমদানির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি খেজুর আসে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। এ ছাড়া তিউনিশিয়া, মিসর, জর্দান, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তান থেকেও খেজুর আমদানি করা হয়।