
এমনিতেই নেতিবাচক ছিল অর্থনীতি। এ অবস্থায় শুরু হয় জুলাই বিপ্লব। ৫ আগস্টের পর পালটে যায় সব হিসাব-নিকাশ। বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে অর্থনীতি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ৭ মাসের চেষ্টা, রমজান ও ঈদ সামনে রেখে অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ঈদের পরপরই আছে আরেকটি উৎসব। চলতি বছর জাতীয় নির্বাচনেরও আভাস আছে। এ সবই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। ফলে রমজান, ঈদ ও পহেলা বৈশাখের উৎসব ঘিরে অর্থনীতি কিছুটা চাঙা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং জাকাত- ফিতরার কারণে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়েছে। অর্থাৎ বাড়তি টাকা বাজারে চাহিদা তৈরি করেছে। অপরদিকে বেড়েছে পণ্যের সরবরাহ। খাদ্য, পোশাক, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিক সামগ্রী এবং অলংকারসহ সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ এবং বিক্রি বেড়েছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত শপিংমল পর্যন্ত বেড়েছে বেচাকেনা। কেনাকাটা বেড়েছে অনলাইনে। জমে উঠেছে ইফতারির বাজার। গ্রামেও টাকার প্রবাহ বাড়ছে। এছাড়াও বিনোদন ও পরিবহণ খাতে বাড়তি অর্থ যোগ হচ্ছে। তবে নেতিবাচক দিকও কম নয়। ঈদের ছুটি ও শুক্র-শনিবার মিলিয়ে ১২ দিন অফিস-আদালত বন্ধ থাকছে। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অপরদিকে বাজারে বাড়তি টাকার কারণে চলতি মাসেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উৎসবকে ঘিরে মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঘন ঘন হাতবদল হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ে। তবে এর সঙ্গে সরবরাহ ঠিক রাখতে না পারলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তাদের মতে উৎসবের অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। তবে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হিসাব বলছে, চলতি মাসেই অর্থনীতিতে বাড়তি ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন যোগ হবে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। করোনার সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এরপর ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্য সংকট। এতে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে রয়েছে। এ অবস্থায় ঈদ ও বৈশাখের মতো উৎসবের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। কারণ এতে দেশে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। তার মতে, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঠিক রাখতে পারলে এই উৎসব পুরোটাই ইতিবাচক বলা যায়। মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, সরকারি চাকরিজীবী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাও বোনাস পাচ্ছেন। বাজারে এই বাড়তি টাকা আসায় কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এতে অভ্যন্তরীণ একটি চাহিদা সৃষ্টি হবে। তবে মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের হিসাবে দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) সম্ভাব্য আকার হচ্ছে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এতে অর্থনীতির আকার বোঝা যায়। তবে উৎসবে কত টাকা লেনদেন হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। রোজা ও ঈদ উৎসবের অর্থনীতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন কয়েক বছর আগে নিজস্ব একটি সমীক্ষা করেছেন। ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে-রোজা ও ঈদে অতিরিক্ত ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন যোগ হয়। সমীক্ষা মতে, পোশাকের বাজারে যোগ হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। নিত্যপণ্যের বাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। জাকাত ও ফিতরা বাবদ আসছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। পরিবহণ খাতে ৮০০ কোটি টাকা। ঈদ ঘিরে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪ হাজার ৫শ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও কয়েকটি খাতের কর্মকাণ্ডে টাকার প্রবাহ বাড়বে। এর মধ্যে রয়েছে ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলিয়ে ৭০ লাখ শ্রমিকের বোনাস। যা ঈদ অর্থনীতিতে আসছে। এছাড়াও রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকা। চলতি মার্চের প্রথম ১৫ দিনে ১৬৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকাররা ধারণা করছেন, এবার ঈদ উপলক্ষ্যে এই রেমিট্যান্স ২৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যা হবে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এছাড়াও দেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে।
জানা গেছে-আলোচ্য তিন উৎসবের মধ্যে শুরুতেই রমজান। এই মাসে মানুষের পণ্য চাহিদা বাড়ে। বিশেষ করে ইফতারে ব্যবহার হয়, এ ধরনের পণ্যগুলোর চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছে-ভোজ্যতেল, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজ, চিনি, ডাল, ডিম, ফলমূল এবং শাক-সবজিসহ অন্যান্য আইটেম। রমজানে সারা দেশে ইফতারকেন্দ্রিক কয়েক লাখ মানুষ মৌসুমি ব্যবসা করেন। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
রমজান শেষে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদে স্বাভাবিকভাবেই টাকার প্রবাহ বাড়ে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, ব্যবসার টাকা, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ এবং জাকাত-ফিতরা মিলিয়ে অর্থনীতিতে নতুন করে দেড় লাখ কোটি টাকা লেনদেন হবে। এর একটি অংশ ইতোমধ্যে গ্রামে চলে গেছে। ঈদ ও রোজার বাড়তি খরচ মেটাতে কৃষক তার মজুত ধান বা অন্যান্য ফসলের একটি অংশ বিক্রি করে দেয়। তরমুজের মৌসুম হওয়ায় অন্য ফলের ব্যবসাও জমে ওঠে। এছাড়াও অর্থবছর শেষ হয়ে আসায় সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ খরচ করার ধুম পড়েছে। ফলে সবকিছু মিলে টাকার স্রোত এবার গ্রামের দিকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই টাকার বড় অংশই যাচ্ছে ভোগ-বিলাসে। আর কিছু অংশ যাচ্ছে গ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পভিত্তিক উৎপাদন খাতে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, তিনটি উৎসব তিন ধরনের। এর মধ্যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। এই রোজার ঈদে টাকার প্রবাহ সবচেয়ে বেশি বাড়ে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এই টাকা পোশাক, ভোগ্যপণ্য, শৌখিনতা ও ভ্রমণসহ বিনোদনমুখী খাতে বেশি ব্যয় হচ্ছে। কাজেই এটা একটা বড় ভূমিকা রাখে অর্থনীতিতে। তিনি আরও বলেন, উৎসব অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। মানুষ এই উৎসব ঘিরে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করেন। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কিছু না কিছু লাভবান হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে মূল্যস্ফীতির শঙ্কা রয়েছে। বাড়তি টাকার প্রবাহের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এতে কিছু মানুষের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজার : ঈদ অর্থনীতির বড় চালিকা শক্তি হচ্ছে পোশাকের বাজার। এ সময় পোশাকের বেচাকেনা তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়। অভ্যন্তরীণ পোশাকের সবচেয়ে বড় জোগান আসছে পুরনো ঢাকার উর্দু রোডের মার্কেট থেকে। ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটসহ দেশের বিভাগ ও জেলা, উপজেলা পর্যায়ে দেশি পোশাক সরবরাহ হচ্ছে এখান থেকে। এখানে সাড়ে চারশ পোশাকের দোকান আছে। চোখের দেখায় দোকানগুলোর আয়তন খুবই ছোট হলেও রোজা ও ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিটি দোকানে কোটি টাকার উপরে বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের বুটিক ও ফ্যাশন হাউজগুলোও বেশ ব্যস্ত। ঈদের বাজার ধরতে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অতিরিক্ত পণ্য তৈরি করেছে।
ভোগ্যপণ্যের বাজার : ঈদে সব ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ভোজ্যতেল, মাংস, চিনি, ডাল, সেমাই এবং পেঁয়াজ। ফলে এসব পণ্যের আমদানিও বাড়ে। রোজা ও ঈদে ভোজ্যতেলের চাহিদা হচ্ছে প্রায় তিন লাখ টন, চিনি ২ লাখ টন থেকে পৌনে তিন লাখ টন, ডাল ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন, ছোলা ৫০-৬০ হাজার টন, খেজুর ১৫ হাজার টন, পেঁয়াজ ৩ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টন এবং রসুনের চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব টাকার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকার জোগান দেওয়া হয়।
বোনাস : এ বছর ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঈদ বোনাস পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে তিন বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজস্ব কাঠামোতে বোনাস দিচ্ছেন। এছাড়া পোশাক ও বস্ত্র খাতের প্রায় ৭০ লাখ কর্মীও বোনাস পাচ্ছেন। যার পুরোটাই যোগ হচ্ছে ঈদ অর্থনীতিতে।
দোকান কর্মচারী বোনাস : ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে সারা দেশের দোকান কর্মচারীদের বোনাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে দেশে ২০ লাখ দোকান, শপিংমল, বাণিজ্য বিতান রয়েছে। একটি দোকানে গড়ে ৩ জন ধরে ৬০ লাখ জনবল কাজ করছে। একজন কর্মীকে ৬ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেওয়া হয়। ওই হিসাবে গড়ে ৮ হাজার টাকার ধরে ৪ হাজার ৮শ কোটি টাকা বোনাস পাচ্ছে এ খাতের শ্রমিকরা। যা পুরোটাই ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। তৃতীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখ। বাঙালির সর্বজনীন উৎসব এটি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই একটি দিনে সবাই যেন বাঙালি হয়ে যায়। বৈশাখের অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট আকার নিয়ে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গবেষণা হয়নি। তবে সূত্রের হিসাবে লেনদেনের সম্ভাব্য পরিমাণ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। উৎসবের জন্য সরকার এ বছরও বোনাস দিয়েছে। করোনা এবং রমজানের কারণে টানা তিন বছর বৈশাখের উৎসব সেভাবে পালন হয়নি। গত বছর ছিল ঈদের ছুটির পরপরই বৈশাখ। সে কারণে তেমন জমে উঠেনি। এ বছর কিছুটা দূরত্ব থাকায় বৈশাখ জমে উঠবে।