
মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে জান্তা সরকারের পক্ষ হয়ে লড়াই করেছে। তবে আরাকান আর্মির কাছে জান্তার পাশাপাশি আরসাও পরাস্ত হয়। এর পর থেকে কোণঠাসা আরসা নেতারা গা-ঢাকা দিতে খুঁজছেন নতুন আশ্রয়। আরাকানে সশস্ত্র যুদ্ধের অনেক আগে থেকে তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থিতু হওয়ার চেষ্টা করেন।
আবার আরসার একটি অংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক অপহরণ, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই করছে। এ কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের নিয়ে আতঙ্কিত। রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা মহিবুল্লাহকে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার কুতুপালংয়ে গুলি করে হত্যার পর আরসার নাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ক্যাম্পে আরও চাপের মধ্যে পড়েন সংগঠনটির সদস্যরা। এরই মধ্যে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ ও তাঁর সহযোগীদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। আতাউল্লাহ পুলিশের কাছে দাবি করেন, এর আগেও কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি।
গত সোমবার রাতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ভূমি পল্লি আবাসিক এলাকায় ভূমি পল্লি টাওয়ারের অষ্টমতলার ফ্ল্যাট থেকে আরসাপ্রধান আতাউল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁর পরিবারের সদস্যসহ আরও পাঁচজন ধরা পড়েন। এর আগের দিন রোববার ময়মনসিংহ শহরে নতুন বাজার এলাকায় ১৫ তলা গার্ডেন সিটির ১০ তলার ফ্ল্যাট থেকে দুই নারীসহ চার আরসা সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে শিশুও ছিল। এ ঘটনায় র্যাব-১১-এর ওয়ারেন্ট অফিসার শাহনেওয়াজ বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে একটি মামলা করেন। এর আগে গত এক বছরে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী, সামরিক কমান্ডারসহ ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আরসার কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আরসা নেতা আতাউল্লাহ ও তাঁর সহযোগীরা বাংলাদেশ হয়ে অন্য কোনো দেশে পালানোর ছক কষছিলেন কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আরসার শূরা বোর্ড (নীতিনির্ধারণী পর্ষদ) ৫৪ সদস্যের। তবে মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর শূরা বোর্ডে ভাঙন ধরে। এ ধরনের খুনোখুনিতে সংগঠনের সম্পৃক্ত হওয়ার প্রতিবাদে ৩২ সদস্য বেরিয়ে যান। যারা তখন আতাউল্লাহর কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতা করছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন মৌলভী সোয়েব। তিনি অনেক দিন আরসার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন।
নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামের মাছ ব্যবসায়ী পরিচয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে সহযোগীদের নিয়ে বাসা ভাড়া নেন আতাউল্লাহ। নভেম্বরে ভূমি পল্লি আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেওয়া হয়। ফ্ল্যাটটি থেকে আতাউল্লাহসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পর আশপাশের লোকজনও বিস্মিত হন। ফ্ল্যাটটির ভাড়া ছিল ১১ হাজার টাকা। এক ব্যক্তি আইডি কার্ড দেখিয়ে তাঁর আত্মীয় থাকবেন এমন কথা বলে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। সোমবার রাতে আরসার প্রধান আতাউল্লাহকে গ্রেপ্তারের খবর দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি শাহীনুর আলম সমকালকে বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে আতাউল্লাহ দাবি করেন, মিয়ানমারে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। তবে তাঁর এই দাবি আমরা বিশ্বাস করছি না। তারা কেন বাংলাদেশে ঢুকেছেন, তা আরও জিজ্ঞাসাবাদ করলে বের হবে।’ ওসি বলেন, আতাউল্লাহ আরও কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন বলে দাবি করছেন। একবার কিছুদিন চট্টগ্রামে ছিলেন বলে জানান। আবার সৌদি আরবও গিয়েছিলেন। এবার আতাউল্লাহর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছেন। তারা বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন কিনা, এটাও জানার চেষ্টা চলছে।
আরেকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৩০টি চৌকিতে হামলা চালানোর জন্য দেশটির কর্তৃপক্ষ আরসাকে দায়ী করেছিল। তখন সেনাবাহিনী ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। হত্যা, ধর্ষণ এবং নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা। ওই বছর রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে প্রথম এই সংগঠনটিরই নাম শোনা গিয়েছিল। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আগে ইংরেজিতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তৎপরতা চালাত। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে। মিয়ানমার সরকার আরসাকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করেছে। অভিযোগ আছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে আর্মির চেকপোস্টে হামলা করায় আরসা। এর পর আরাকার আর্মির সঙ্গে রাখাইনে সংঘাত শুরু হলে আরসাকে প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবহার করতে শুরু করে জান্তা সরকার। রোহিঙ্গারা জান্তা সরকারের পক্ষ হয়ে লড়তে থাকে। তাদের বলা হয়, আরাকান আর্মিকে পরাজিত করতে পারলে নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে আনা হবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের। তবে জান্তা সরকার পরাজিত হওয়ার পর সেখানে বেকায়দায় পড়ে আরসা ও সাধারণ রোহিঙ্গারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, আতাউল্লাহর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের সিকদারপাড়ায়। ১৯৬০ সালের দিকে তাঁর বাবা পাকিস্তানের করাচি চলে যান। সেখানেই জন্ম আতাউল্লাহর। তিনি পড়াশোনা করেন সৌদি আরবের মক্কায়। ২০১২ সালে আতাউল্লাহ সৌদি আরব যান। ২০১৬ সালের দিকে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। ওই বছর অক্টোবরের শুরুতে আরাকান রাজ্যে সে দেশের সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালান। এতে দেশটির বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ওই সময় হামলার দায় স্বীকার করে আরসার কমান্ডার আতাউল্লাহ অনলাইনে ভিডিও বার্তা প্রচার করেন। এর পর থেকে আরসা ও আতাউল্লাহকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। তবে প্রথমে আরসার শীর্ষ নেতা ছিলেন মৌলভী হাশেম। ২০২২ সালে তিনি মারা যান। হাশেম জীবিত থাকা অবস্থায় আরসার নেতৃত্বে চলে আসেন আতাউল্লাহ। আরসায় কট্টর ও মধ্যপন্থি এ দুটি ধারা রয়েছে। মূলত কট্টরপন্থিদের কাছে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আতাউল্লাহ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক খুনোখুনি ও নানা অপরাধে আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি মামলা রয়েছে। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার রিজওয়ান রুশদী। ওই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আতাউল্লাহ।
আরসার সদস্যদের বিরুদ্ধে ২ মামলা
ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, ময়মনসিংহ নগরীতে গ্রেপ্তার আরসার চার সদস্যসহ ১০ রোহিঙ্গার নামে দুটি মামলা হয়েছে। মামলায় ৩০ লাখ টাকা ও ১২ ভরি স্বর্ণালংকার জব্দ দেখানো হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে র্যাব-১১-এর সুবেদার হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দুটি করেছেন। ময়মনসিংহ নগরীর ব্যস্ত এলাকা নতুনবাজার মোড়। এই মোড়ে ১৫ তলা গার্ডেন সিটি ভবনের ১০ তলার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন আরসার চার সদস্য। ভবনটির মালিক নরসিংদীর পলাশ এলাকার মাজহারুল ইসলাম। বাসাটি ভাড়া দিয়েছিলেন ভবনের দারোয়ান নিজাম উদ্দিন।
আরসা সদস্যরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাসাটি ভাড়া দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাড়ার নোটিশ দেখে চার মাস আগে দুই ব্যক্তি বাসাটি ভাড়া নিতে চান। তারা নিজেদের ঈশ্বরগঞ্জের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেন। ভাড়া দেওয়ার সময় তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চান। কিন্তু তারা ‘দিব, দিচ্ছি’ বলে অনেক দিন কাটিয়ে দেন। পরে মনিরুজ্জামান নামে পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দেন। এটিতে বাড়ি উচাখিলা ইউনিয়নের চর আলগী লেখা, বাবার নাম মো. আতিকুল ইসলাম। ভবনটির ১১ তলার বাসিন্দা আনিসুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, ওই ফ্ল্যাটে যারা থাকতেন, তারা ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না।