
ঢাকার আজিমপুরে ৩৩.৬৮ একর জমিতে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণের (জোন-এ) কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। ২০২১ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এরই মধ্যে দুই ধাপে মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ করা যায়নি কাজ। এর মধ্যে নতুন করে আরও এক বছর সময় বাড়ানোর পাশাপাশি সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পর্যালোচনা করে ৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোরও প্রস্তুতি চলছে। কাজের জন্য ঠিকাদারদের নিয়মিত অর্থ দেওয়া হলেও কয়েকটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কাজ করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে, যার অন্যতম ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন। এজন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। জানা গেছে, বর্ধিত সময়সীমা অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও মাত্র ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি।
জানা গেছে, প্রকল্পের জন্য মূল বরাদ্দের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হলেও কাগজে-কলমে কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮০ শতাংশ, যদিও প্রকৌশলীরা বলছেন, সার্বিকভাবে ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অর্থছাড় দেওয়া হয়েছে ২০৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ১৫টি বহুতল ভবনের মধ্যে ৪টি মূল ভবন, মসজিদ, ইউটিলিটি ভবন, ক্লাব ও মাঠ তৈরি, কার পার্কিং ও নলকূপ বসানোর কাজসহ বিভিন্ন কাজ এখনো চলমান।
এ প্রকল্পের শুরুতে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে গণপূর্ত অধিদপ্তর আজিমপুরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমেদের বিরুদ্ধে। তখন প্রকল্পের কাজের টেন্ডার হওয়ার পর বিভিন্ন অনিয়মের কারণে একটি মামলা হয়। তার পরও সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রায় অর্ধযুগ এই ডিভিশনের দায়িত্বে থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস সিন্ডিকেট তৈরি করে সরকারি অর্থ লুটপাটসহ নানা অনিয়মে জড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে। ঠিকাদার থেকে ১০-১২ শতাংশ ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও ঘুষ-বাণিজ্য করায় প্রকল্প শুরুর বছরখানেক পরই ইলিয়াস আহমেদের বিরুদ্ধে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীরা গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। তবে গণপূর্তের সাবেক মন্ত্রী শরীফ আহমেদের সঙ্গে সখ্যের সুবাদে শাস্তির বদলে তিনি পদোন্নতি পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। গত আগস্টে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর তিনি বদলি হন সিলেটে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতা ও দলীয় ঠিকাদারকে অর্থের জোগানের অভিযোগে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে তাকে।
আজিমপুর বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রকল্পের শুরুতেই আইনের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো ডিপিপিতে ব্যয় ধরা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশোধিত ডিপিপিতে ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া কোথায় কী পরিমাণ কোন কোম্পানির কোন জিনিস ব্যবহার করা হবে, তা ঠিকমতো উল্লেখ করা হয়নি। একই সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে কাজের পরিধি কামানো হলেও অর্থ সমন্বয় করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলীর ফয়সাল হালিম কালবেলাকে বলেন, গত বছর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কাজের অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ। কাজের অগ্রগতি না হওয়ার জন্য ঠিকাদার দায়ী। এর মধ্যে ঠিকমতো কাজ না করায় ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশনকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পারেনি। তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিলও হতে পারে।
সংশোধিত ডিপিপিতে দেখা গেছে, গভীর নলকূপ জলাধার ও গাছের জন্য প্রায় ১৭ কোটি, সীমানা প্রাচীর ও অরনামেন্টাল গেট ৯ কোটি ৮৪ লাখ, মাটি পরীক্ষা ও ডিজিটাল সার্ভে ৫৫ লাখ, আরসিসি রাস্তা, পার্কিং, ফুটপাত ওয়াকওয়ে ও আরসিসি ডাস্টবিন ২২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এই ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কৌশলে অতিরিক্ত দাম ধরে সরকারি অর্থ লোপাট করা হচ্ছে।
সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী, প্রথমে ৬৫ হাজার ৪৪৫ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন জন্য ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হলেও ডিপিপি সংশোধন করে বাড়তি ৪৮৩৫ ঘনমিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি টাকা। সংশোধন করার আগে প্রতি ঘনমিটার মাটি উন্নয়নের জন্য ৬৩৫ টাকা ব্যয় ধরা হয়। ডিপিপি সংশোধন করে ১ হাজার ৪১৫ টাকা বাড়িয়ে ২ হাজার ৬০ টাকা করা হয়। ৪ হাজার মিটার সীমানা প্রাচীর অরনামেন্টাল গেটের জন্য ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ধরা হলেও সংশোধন করে পরে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। এতে প্রতি মিটারে ৯২৫ টাকা বৃদ্ধি করে মিটারপ্রতি খরচ ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৬০০ টাকা। ১৫ হাজার বর্গমিটার জলাশয় উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি টাকা। প্রতি বর্গমিটার জলাশয় উন্নয়ন আধুনিকীকরণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার টাকা। ভূগর্ভস্থ জলাধার (অগ্নিনির্বাপক) ৬ লাখ ৫০ হাজার গ্যালনের খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ডিপিপি সংশোধন করে প্রায় ২ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৭ কোটি ৬ লাখ টাকা করা হয়েছে। প্রতি গ্যালনের দাম ধরা হয়েছে ১০৮ টাকা।
ভবনগুলোর বেসমেন্টে, গ্রাউন্ড ফ্লোরে এবং সার্ফেস কার পার্কিং পর্যাপ্ত না হওয়ায় ১টি ১২তলা বিশিষ্ট মেকানিক্যাল কার পার্কিং করার কথা বলা হয়েছে। মেকানিক্যাল কার পার্কিংয়ে ২৮৮টি গাড়ি রাখার কথা উল্লেখ করা হলেও করা হয়েছে ২৪০টি। এতে প্রায় ১১ কোটি টাকা কম খরচ হলেও ওই টাকা উদ্বৃত্ত দেখানো হয়নি। এই বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
ডিপিপি তথ্যে দেখা গেছে, ১৮শ বর্গফুটের ২২৮টি ফ্ল্যাটের জন্য ২০তলার ৩টি ভবন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৮ কোটি ৩১ হাজার টাকা। ১৫শ বর্গফুটের ৬০৮টি ফ্ল্যাটের জন্য ২০তলায় ৮টি ভবন নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২০ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ১২৫০ ফুটের ৩০৪টি ফ্ল্যাটের ৪টি ভবন নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ৩২৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ইউটিলিটি ভবনগুলো নির্মাণ (মাল্টিপারপাস ভবন, ৫টি ক্লাব হাউস, ২টি গণপূর্ত সার্ভিস মেইনটেন্যান্স ভবন, কার পার্কিং ভবন) নির্মাণের জন্য মূল ডিপিপিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধনে ২২ কোটি বৃদ্ধি করে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। মাটি পরীক্ষা ও ডিজিটাল সার্ভে ৫৫ লাখ টাকা। ভূগর্ভস্থ জলাধার (অগ্নিনির্বাপক) ৭ কোটি ৬ লাখ, গভীর নলকূপ (ডিস্ট্রিবিউশন লাইনসহ) ৪টি ৬ কোটি টাকা, আরবরিকালচার ও প্লে গ্রাউন্ড উন্নয়ন ৪ কোটি, মসজিদসহ ধর্মীয় স্থান উন্নয়ন ও উপাসনালয় নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া ডেসকো-ডিপিডিসির চার্জ ৮ কোটি ৫০ লাখ, ওয়াসা সংযোগ চার্জ ২ কোটি ৬০ লাখ, আধুনিক ভবন তৈরির অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশ ভ্রমণ খরচ ১ কোটি টাকা, সাব-স্টেশন যন্ত্রপাতি এইচটি ক্যাবল, ফ্লোর ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড রিং মেইন ইউনিটসহ (১২৫০/১০০০ কেভি) ১৭টি ৫৩ কোটি, ডিজেল জেনারেটর (১৭টি) ১৫০/১০০ কেভি ফুয়েলসহ ৬ কোটি ৯৪ লাখ, লিফট ৬১ কোটি ৫১ লাখ, পাম্প মোটর সেট ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
মূল ডিপিপিতে থেকে সংশোধন করে প্রায় ১ কোটি টাকা বাড়িয়ে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও ফায়ার রেটেড ডোর ২৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা করা হয়েছে। একইভাবে সৌরবিদ্যুতে ব্যয় প্রায় ১ কোটি বাড়িয়ে (৫৪০ কি.ওয়াড) ৭ কোটি ৭৫ লাখ ধরা হয়েছে। কম্পাউন্ড এবং গেইট লাইট, লাইটিং এরেস্টর, লাইটিং কন্ডাক্টর ও পানির হিটারে ব্যয় ৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। ৮ কোটি বাড়িয়ে বেসমেন্টে কৃত্রিম ভেন্টিলেশন সিস্টেম ও এয়ার কুলার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সিসিটিভির ব্যয় প্রায় ২ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। তবে এসব জিনিস কোনো জায়গায় কী পরিমাণ ব্যবহার করা হবে, তা নিদিষ্ট করে উল্লেখ নেই। এ ছাড়া পিএবিএক্স সিস্টেম, টেলিফোন নেটওয়ার্ক/ইন্টারকম, মসজিদ, মন্দির ডকুমেন্টারি ডিভাইসসহ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখ, পাজেরো জিপ ১টি ৯৫ লাখ, ২টি ডাবল কেবিন পিকআপ ৫৫ লাখ, ১টি প্রাইভেটকার ৩০ লাখ, ২টি মোটরসাইকেল ৪ লাখ, মোট ২ কোটি ৩৯ লাখ। গাড়ির নিবন্ধন ১৫ লাখ, জ্বালানি খরচ ১৫ লাখ। এ ছাড়া ফিজিক্যাল ও প্রাইস কনটিনজেন্সি ৪ শতাংশ।
সরেজমিন দেখা গেছে, আজিমপুর সরকারি কলোনির ১৫টি বহুতল ভবনের মধ্যে ৪টি মূল ভবন, মসজিদ নির্মাণ, ইউটিলিটি ভবন, ক্লাব ও মাঠ তৈরি, কার পার্কিং ও নলকূপ বসানোর কাজসহ নানাবিধি কাজ এখনো চলছে। কোনোটা শেষের দিকে আবার কোনোটা শুরু হয়েছে। নতুন করে একটি পুকুর খনন করা হলেও বাকি দুটার মধ্যে একটি চারদিকে সীমানা প্রচীরের কাজ চলছে। যেটির করা হয়েছে, তাও ভেঙে গেছে। এ ছাড়া পুকুরের বিভিন্ন ময়লা আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। গাছের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা বরাদ্দ রাখা হলে এখন পর্যন্ত গাজ লাগানো হয়নি। এ ছাড়া আর সি সি রাস্তা, পার্কিং, ফুটপাত ওয়াকওয়ে তৈরি করা হলে কোথায় কোথায় ভেঙে গেছে। সবচেয়ে অদ্ভুত কথা হচ্ছে, দীর্ঘ বছর ধরে থাকা একটি পুকুরের বড় একটি অংশ ভরাট করা হয়েছে। তবে নতুন করে জলাধার নির্মাণেও বিপুল অর্থ ব্যয় করছে সংস্থাটি।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পের কাজ চলমান। দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি কারণে কাজের গতি ধীর হয়েছে। আরও এক বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। কাজের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নতুন আসছি তাই ঠিকমতো জানা নেই।’
ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশনের প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. দেলোয়ার কালবেলাকে বলেন, কয়েক মাস কাজ বন্ধ রেখেছে কোম্পানি। অন্যান্য কোম্পানির কাজের অগ্রগতি থাকলেও আমাদের কাজের অগ্রগতি কম। কাজের জন্য ২৪ মাস সময় দিলেও ৩৬ মাসে শেষ হয়নি। তাই গণপূর্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে চুক্তি করার কথা বলছে।