Image description
 

 ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হামলাকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২২ শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করা গেছে।

 
 
এছাড়াও অন্তত ৭০ জন শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে হামলাকে উসকে দিয়েছেন।

 

১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত সহিংসতার ঘটনা তদন্তে সত্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

গত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সহিংসতার ঘটনায় ৮ অক্টোবর একটি সত্যানুসন্ধান কমিটি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ের পাশে লাউঞ্জে তথ্যানুসন্ধান কমিটির আহবায়ক ও আইন অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুল হক সুপণ উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের হাতে এই প্রতিবেদন তুলে দেন।

পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি প্রতিবেদনে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।

তিনি জানান, হামলাকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২২ জনকে চিহ্নিত করা গেছে। এছাড়াও বহিরাগত অনেকেই নাম প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে কেবল হামলার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে, এমন নাম দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হামলার ২৫ ভাগ এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বলে মনে করছেন আহ্বায়ক সুপণ।

হামলাকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৫ জুলাইয়ের হামলা ছিল পুরোটাই পরিকল্পিত। সেখানে দুইটি গ্রুপ ছিল সাদা ক্যাপ পরিহিত; একটি গ্রুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্বরে, আরেকটি গ্রুপ ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগের সামনে। এটি একদিনে হয়নি। আগে থেকে পরিকল্পনা না হলে এভাবে সম্ভব না। হামলায় সরকারি বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী আছে। এটি একদিনে হয়নি।

তিনি বলেন, মেয়েদের ওপর হামলা ১৫ জুলাইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মেয়েদেরকে বাস থেকে নামাচ্ছে এবং পেটাচ্ছে। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। অনেক ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে আছে, লাঠি দিয়ে বাছবিচার ছাড়া পেটাচ্ছে, এখানে ঘটনা এমন ছিল না। বরং মেয়েগুলোকে ধরে ধরে পেটানো হচ্ছে। একজন মেয়ে হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে চাচ্ছিল, তার হাত ধরে রেখেছে, এটা তো শ্লীলতাহানির পর্যায়ে পড়ে। মেয়েদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী জড়িত ছিল। তবে বাইরের বেশি ছিল।

তিনি বলেন, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার, ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের ফটকের এবং জরুরি বিভাগের ভেতরেও হামলা হয়েছে। ডাক্তারদের চিকিৎসা না দিতে বলা হয়েছে। সেসব ভিডিও আমরা পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের একটি অনুসন্ধান হলো, যারা হামলায় বেশি নৃশংসতা দেখিয়েছে, তারা অনেকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। তার ৬ বছরে অনার্স শেষ করার কথা, অথচ ১১ বছরে ধরে অনার্স চলছে। কীভাবে? অনেক ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু তারা হলে ছিল। কীভাবে ছিল? যারা হলপাড়ায় শিক্ষার্থীদের মেরেছে, তারাই মলচত্বরে পেটাচ্ছে, তারাই উপাচার্যের বাসভবনের সামনে পেটাচ্ছে। এরা ওই শিক্ষার্থীরাই, যারা অনেকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন জড়িত কী না প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা একটা সাধারণ বক্তব্য। যেমন উপাচার্যের বাসভবনের ফটকের সামনে মেয়েদের পেটানো হচ্ছে। ওনারা কিছু জানেন না। ১৬ তারিখ বাইরে থেকে বাস এনে মুহসীন হলের মাঠে রাখা হয়েছে। আমরা প্রশাসনের কোনো ব্যবস্থা দেখেছি? মুজিব হলের পকেট গেট দিয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ করানো হয়েছে, হলের কর্মচারীরা প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের ফোন দিয়েছে। তারা ফোন ধরেনি। এখানে শুধু অবহেলা হয়েছে ব্যাপারটা এমন নয়, হয়তো তারা এসব জানতো। তবে কোনো শিক্ষক সরাসরি জড়িত কী না, তা আমরা প্রমাণ পাইনি, তবে জড়িত থাকলেও থাকতে পারে।

তিনি বলেন, উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মেয়েদের পেটানো হচ্ছে। আমাদের কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে, উনি উঁকিও দেননি। কোনো মন্তব্য করেননি। পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থাও নেননি।

এ প্রতিবেদনে হামলা ও সহিংসতার কতটুকু কাভার করা হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আরও শনাক্ত করার সুযোগ আছে। তবে আমরা মনে করি, ২৫ ভাগ তুলে আনতে পেরেছি আমরা।

সিসিটিভি ফুটেজের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ব্যাক্তিগত ভিডিও সংগ্রহ করেছি। কিন্তু আমরা সিসিটিভি ফুটেজ পাইনি। প্রত্যেক হলের হার্ডড্রাইভ খুলে নিয়ে গেছে। ভিসি চত্বরের হার্ডড্রাইভে আমরা কিছু পাইনি। অনেক জায়গায় ক্যামেরা এমনভাবে লাগানো, কেবল গাছ দেখা যায়।

প্রায় ৭০ জন শিক্ষক হামলা উসকে দেওয়ার ভূমিকা রেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীরা প্রক্টর বরাবর এসবের অভিযোগ করেছে, সেগুলো আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী সরাসরি আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। ফেসবুকে আমরা দেখেছি। যারা আন্দোলন করছে, তাদেরকে ‘পাকিস্তানের দালাল’, ‘শিবিরকর্মী’ বা ‘ছাত্রদল কর্মী’-বলে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছে। ছাত্ররা এসব পোস্ট প্রিন্ট করে আমাদের কাছে জমা দিয়েছে। সেসব শিক্ষকরাও এমন স্ট্যাটাসের কথা স্বীকার এবং দুঃখ প্রকাশ করেছে।

হামলাকারীদের শাস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মামলা করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একাডেমিক ব্যবস্থা নিতে পারে। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, তাদের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে একাডেমিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আমরা সুপারিশ করেছি।

যেভাবে করা হয়েছে প্রতিবেদন

প্রতিবেদনের সঙ্গে দেওয়া সংবাদ সংক্ষেপে সত্যানুন্ধান কমিটি জানায়, অভিযোগকারীরা অভিযোগ দায়েরের সময় যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ জমা দিয়েছিল তার সঙ্গে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কন্টেন্ট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বিচার বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। তথ্যানুসন্ধান কমিটি বিচারিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সাক্ষ্যের বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড অনুসরণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করতে সচেষ্ট থেকেছে। নির্দোষ কেউ যাতে হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত না হয়, তথ্যানুসন্ধান কমিটি সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক ছিল।

প্রতিবেদনে তারা জানান, ১৫ জুলাইয়ের হামলার নিকৃষ্টতম দিক ছিল নারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে যাওয়ার পথে আহত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আহতদের ওপর হামলা এবং ডাক্তারদের চিকিৎসাপ্রদানে বাধা প্রদান। যুদ্ধের সময়ও নারী ও শিশুদের বিশেষ নিরাপত্তা প্রদান করা হয়।

আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে যুদ্ধের সময় চিকিৎসারত আহতদের ওপর হামলা এবং হাসপাতালে হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কারণে হাসপাতালে এবং নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তথ্যানুসন্ধান কমিটি শতাধিক হামলাকারীকে চিহ্নিত করেছে।

প্রতিবেদন গ্রহণ শেষে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ১৫ জুলাইয়ের ঘটনা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, জাতীয় জীবনে এর প্রতিফলন ঘটেছে। এ ঘটনার পরম্পরায় একটি গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস রচিত হয়েছে। তথ্যানুসন্ধান কমিটি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

তিনি বলেন, এটি সিন্ডিকেটে উন্মোচিত হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এরপর তদন্ত কমিটি ও ট্রাইবুন্যাল গঠনের মতো আইনি প্রক্রিয়াগুলো হবে। সত্যানুসন্ধান কমিটি তদন্তের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করেছে। ফলে প্রতিবেদন তৈরি করতে তূলনামূলক সময় লেগেছে।

সভায় উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেসানী, শামসুন নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ নাসরিন সুলতানা ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদিয়া নেওয়াজ রিমি উপস্থিত ছিলেন।