Image description

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত পরাজয় ঘটে। দলের নেতা-কর্মীরা ভাবতেই পারেননি, বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। ভোটের পর দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নেতাদের মধ্যে অত্যধিক আত্মবিশ্বাস, দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, তৃণমূল কর্মীদের অবমূল্যায়নসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। অন্যদিকে ১২ ও ১৩ মার্চ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দলীয় সভানেত্রী বরাবর ১২ পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি লেখেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. কামাল হোসেন। চিঠিতে তিনি দলের পরাজয়ের ‘ব্যবচ্ছেদ’ করেন। ওই চিঠিকে শেখ হাসিনা ভালোভাবে না নিয়ে এটাকে ‘দল ভাঙার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখেন। এর পর থেকে হাসিনার সঙ্গে শুরু হয় কামালের বৈরিতা। ড. কামালের ওই চিঠির খবর জাতীয় পত্রিকাগুলো গুরুত্বসহকারে ছাপে। সেই সব ঘটনা নিয়ে আজকের ফিরে দেখা।

’৯১–এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়

 

দীর্ঘ ৩৪ বছর আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা  বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করবে—এমন ধারণা রাজনৈতিক মহল, ভোটার ও অনেক মানুষের মধ্যে ছিল। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে বিজয়ী হয় আপসহীন নেত্রীখ্যাত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি; যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেবেন, সেই আলোচনা ভোটের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওই নির্বাচনে ড. কামাল হোসেন মিরপুর আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপির প্রার্থী হারুন মোল্লার কাছে ২ হাজার ১৩৬ ভোটে পরাজিত হন।

নির্বাচনে জিতে বিএনপি সরকার গঠন করলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটের ব্যবধান ছিল এক শতাংশেরও কম। বিএনপি পায় ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট, আওয়ামী লীগ পায় ৩০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। জামায়াত ১২ দশমিক ১৩ শতাংশ আর এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি পায় ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট।

নির্বাচনে পরাজয়ের পর ব্যর্থতার দায় নিয়ে ৩ মার্চ সভানেত্রীর দায়িত্ব থেকে দলের সাধারণ সম্পাদকের (সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী) কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন শেখ হাসিনা। পরের দিন দলের কয়েক হাজার নেতা–কর্মী ৩২ নম্বরের সামনে সমবেত হয়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য আবেদন জানান। ৫ মার্চ পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

মূলত ভোটে পরাজিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোন্দল ও তৃণমূলের মধ্যে নানা দুর্বলতা নিয়ে দলের ভেতরে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়! দলের দুর্বলতাগুলো নিয়ে সবার আগে প্রশ্ন তোলেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহচর ড. কামাল হোসেন।

শেখ হাসিনাকে ড. কামালের চিঠি

আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে ১২ পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. কামাল। চিঠিতে বলা হয়, দলের নেতাদের অতিবিশ্বাস, দলীয় কোন্দল, আত্মম্ভরিতা ও কর্মবিমুখতা নির্বাচনে পরাজয়ের মূল কারণ। যদিও অসুস্থতার জন্য তিনি ১২ ও ১৩ মার্চ দুই দিনব্যাপী ওয়ার্কিং কমিটির ওই সভায় যোগ দিতে পারেননি। ৫৪ জন নির্বাহী সদস্যের কাছে তাঁর ওই চিঠি দেওয়া হয়। 

চিঠিতে ড. কামাল বলেন, ‘২৭ ফেব্রুয়ারির অনেক আগেই আমরা আমাদের বিজয় সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। নির্বাচনকে আমরা আনুষ্ঠানিকতা এবং সময়ের ব্যাপার হিসেবে ধরে নেই। আমাদের নেতা-কর্মীরা নিশ্চিত বিজয়ের আগাম গর্বে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাওয়া, ভোটের কার্ড বিলি করা ইত্যাদি কাজে আদৌ মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে নাই। এমনকি ভোটের দিন স্ব স্ব ভোটকেন্দ্রে ভোটদান কার্য পরিচালনা করা ও তদারকি করা এজেন্ট থাকার মতো অতি অত্যাবশ্যকীয় কাজ বাদ দিয়ে খোশগল্প ও অন্যান্য সব কেন্দ্রে গিয়ে মাতব্বরি করার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।’

কামাল হোসেনের মতে, আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দল সব শক্তি দিয়ে ভোটের ফল তাদের অনুকূলে আনার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করেছে। বহুসংখ্যক আসনে কেবল অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নিশ্চিত বিজয় নস্যাৎ হয়েছে।

দলীয় কোন্দল ও প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করা

 

চিঠিতে ড. কামাল একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, জামালপুরে মেজর জেনারেল (অব.) খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফুলের মালা প্রতীকে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন। প্রচার করেছেন যে তিনি দলীয় সভানেত্রীর প্রার্থী। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের অনেক দায়িত্বশীল নেতা-কর্মী দলের প্রার্থী জেনারেল খলিলের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেনি বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন ড. কামাল।

ড. কামাল জানান, জোহরা তাজউদ্দীনের মতো ত্যাগী ও সংগ্রামী নেত্রীকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করতে গিয়ে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, অনেক নেতা-কর্মী দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। ড. কামাল আরও উদাহরণ দিয়ে বলেন, নেত্রকোনার ফজলুর রহমান খান, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর নূরুল ইসলাম বিএসসি, চন্দনাইশের জাফর আহমদ চৌধুরী এবং নারায়ণগঞ্জের কতিপয় আসনসহ সারা দেশে দলীয় প্রার্থীরা উপকোন্দলের শিকার হয়েছেন।

কামাল হোসেনের ১২ পৃষ্ঠার চিঠির পর গুঞ্জন ওঠে, তিনি মনে হয় আর আওয়ামী লীগে থাকবেন না। যদিও তিনি অসুস্থতার কথা বলে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে অনুপস্থিত ছিলেন।

শেখ হাসিনার ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’তত্ত্ব

২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে হারার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ভোটে ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ তোলেন। কিন্তু দলীয় সভানেত্রীর বক্তব্যের বিপরীতে বক্তব্য দেন ড. কামাল হোসেন। তিনি দাবি করেন, ‘ভোট সুষ্ঠু হয়েছে।’ এতে বিপদে পড়েন তিনি। নিজ দলের নেতা-কর্মীদের রোষানলে পড়েন। তাঁর গাড়িতে হামলা পর্যন্ত হয়। তখন থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে কামাল হোসেনের দূরত্ব তৈরি হয়। শেখ হাসিনা ড. কামালের ওই চিঠিকে ভালোভাবে নেননি। পরে ১৯৯২ সালে তিনি আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা ডেকে সব সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে চিঠি দেন। ওই চিঠিতে শেখ হাসিনা লেখেন-‘একটি মুখোশধারী চক্র দলে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করছে। নানা কৌশলে সস্তা সেন্টিমেন্টমূলক বক্তব্য দিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আজ আমার ও আওয়ামী লীগের ইমেজকে খাটো করা হচ্ছে।’

শেখ হাসিনার ওই চিঠিতে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে দলীয় নেতা-কর্মীরা বুঝে নিয়েছিলেন যে চিঠির বিষয়বস্তু ড. কামাল হোসেন।

এর কিছুদিন পর দলীয় কাউন্সিলে প্রেসিডিয়াম সদস্যপদ হারান বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন। তাঁকে বানানো হয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। সেই থেকে লীগের রাজনীতিতে আর সক্রিয় হননি তিনি।

নতুন দল ‘গণফোরাম’-এর আত্মপ্রকাশ

 

পরে তাঁর উদ্যোগে তৈরি হয় অরাজনৈতিক সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ফোরাম।’ ১৯৯৩ সালের ২৯ আগস্ট সকালে শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কামাল হোসেন। সেই দিনই ‘গণফোরাম’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি।

নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে সত্যিই চমক দেখান বরেণ্য আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন। তিনি আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের তৎকালীন মন্ত্রী, এমপিসহ নামকরা নেতাদের গণফোরামে ভেড়ান। এ ছাড়া আইনজীবী, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাদের তাঁর দলে জায়গা দেওয়া হয়। তবে দল গঠনের শুরুতে পার্টিতে কোনো সেক্রেটারি বা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাউকে রাখা হয়নি। তবে দলে ১২ সদস্যের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং ৮৬ সদস্যবিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি রাখা হয়েছিল।

 

গণফোরামের বর্তমান সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেন, ‘৯২ সালে আমাকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বেশির ভাগ সদস্য ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। তবে শেখ হাসিনা একক ক্ষমতাবলে আমাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন। এর ফলে ভাঙনের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি, জাতীয় পার্টি, জাসদসহ বিভিন্ন দলের এমপি, সাবেক মন্ত্রীসহ খ্যাতিমান রাজনীতিবিদেরা যোগ দেন। যদিও পরে অনেক নেতা গণফোরাম ছেড়ে মূল দল আওয়ামী লীগে ফিরে যান।’

 

বর্তমান প্রেক্ষাপট

গত ৩২ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দলে নানা ভাঙনের মুখে পড়ে গণফোরাম। পাল্টাপাল্টি বিবৃতি এবং পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতির ময়দান। সবশেষ ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দুই গণফোরাম এক হয়ে ঐক্যবদ্ধ সম্মেলন করে। গঠন করা হয় ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি। এই সম্মেলনে দলের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেনকে ‘ইমেরিটাস সভাপতি’ নামে নতুন পদ তৈরি করে তাঁকে সম্মানিত করেন তাঁর অনুসারীরা। নতুন কমিটিতে সভাপতি হয়েছেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ড. মিজানুর রহমান। কোনরকমে ঢিমেতালে চলছে গণফোরাম। এখনো যেকোনো বিষয়ে একমাত্র ভরসার স্থল ৮৮ বছর বয়সী বরেণ্য রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন।

তথ্যসূত্র

১. বাংলাদেশ নির্বাচন জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ (১৯৪৭-২০১২)-অ্যাডভোকেট এ বি এম রিয়াজুল কবীর কাওছার

২. বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ক্রমবিকাশ (১৮৬১-২০০৮)-হারুন-অর-রশীদ

৩. জাতীয় সংসদ নির্বাচন হ্যান্ডবুক, আরএফইডি, ২০০৬

৪. বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি, ড. আবুল ফজল হক, ২০০৭

৫. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ মার্চ ১৯৯১

৬. যুগান্তর, ৮ নভেম্বর ২০১৮

৭. আজকের কাগজ, ৩০ আগস্ট, ১৯৯৩

৮. দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, ৩০ আগস্ট ১৯৯৩