
জুলাই অভ্যুত্থানের সাত মাস পার হয়ে গেলেও আন্দোলনকারীদের অনেকেই এখনো নিখোঁজ। এরকম ৩১টি ঘটনা অনুসন্ধান করেছি আমরা—যার মধ্যে ছয়জনকে রায়েরবাজার কবরস্থানে অজ্ঞাতনামা হিসেবে দাফন করা হয়েছে, চারজনকে আশুলিয়ায় পোড়ানো মরদেহগুলোর মধ্য থেকে শনাক্ত করা হয়েছে, দুজনের মরদেহ ডিএনএ পরীক্ষার পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ১৯ জন আজও নিখোঁজ।
নথিপত্র ও মরদেহ লুকিয়ে ফেলার মাধ্যমে শহীদদের যেন খুঁজে বের করা না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে বিগত সরকারের পরিকল্পিত প্রয়াসের প্রমাণ মিলেছে এই অনুসন্ধানে।
এই চার পর্বের বিশেষ প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, কীভাবে হাসপাতালের মর্গ থেকে মরদেহ নিয়ে যেতে পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি। এখন স্বজনদের মরদেহের অপেক্ষায় দিনযাপন করছেন তারা। আজ প্রথম পর্ব--
আবু সাইদ হত্যার দুই দিন পর, ১৮ জুলাই বিকেলে যাত্রাবাড়ীর নিজ বাসা থেকে বের হন সোহেল রানা (২৮) বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে। কিন্তু মাকে তা না জানিয়ে শুধু বলে যান, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরছি। তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী চার আন্দোলনকারী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আন্দোলনে যোগ দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে সোহেলকে আটক করে পুলিশ। বেধড়ক মারধরের পর তাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়।
শাহবাগ থানা থেকে পাওয়া সোহেলের সুরতহাল প্রতিবেদনেও লেখা, তার বুকের দুপাশে একাধিক গুলির চিহ্ন এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের দাগ পাওয়া গেছে।
ঢাকার এই পরিস্থিতি দেখে এর পরদিন দেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন ফয়সাল সরকার (১৮)। উত্তরার আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে এসে মাকে ফোন দেন এই কলেজশিক্ষার্থী। জানান কিছুক্ষণের মধ্যেই কুমিল্লার বাসে উঠবেন।
সেটিই ছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ ফোনালাপ।
একই দিনে উত্তরার আরেক জায়গায় গাড়িচালক ও দুই সন্তানের বাবা আসাদুল্লাহ (৩০) আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কয়েকজন হেলমেটধারী সন্ত্রাসীর গুলিতে গুরুতর আহত হন।
ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তোলা একাধিক ছবি যাচাই করা বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে দ্য ডেইলি স্টার।
সোহেল, ফয়সাল, আসাদুল্লাহ; কেউই হয়তো একে-অপরকে চিনতেন না। কিন্তু মৃত্যু তাদের এক করে।
২৪ জুলাই, কারফিউয়ের মধ্যে 'অজ্ঞাতনামা' হিসেবে রায়েরবাজার কবরস্থানে একসঙ্গে দাফন করা হয় তাদের।

পুলিশি প্রতিবেদনের সঙ্গে হাসপাতাল, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ও রায়েরবাজার কবরস্থানের নথি পর্যালোচনা করে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, এর আগে আরও অনেকের সঙ্গে এই তিনজনের লাশ পড়ে ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।
দেশব্যাপী কারফিউয়ের মাঝে স্বজনদের খোঁজ করার সুযোগ না দিয়েই এই 'অজ্ঞাতনামাদের' দাফন করে কর্তৃপক্ষ।
গণঅভ্যুত্থানের সাত মাস হয়ে গেলেও অন্তত ১৯টি পরিবার এখনো তাদের বাবা, ছেলে, ভাই বা স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তারা সবাই আন্দোলনের সময় নিখোঁজ হয়েছেন। ১৯ জনের মধ্যে ১২ জনই নিখোঁজ হয়েছেন অভ্যুত্থানের শেষ দুই দিন—৪ ও ৫ আগস্টে।
তাদের সঙ্গে কী হয়েছে, তারা কীভাবে গুম হয়েছেন; এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার তেমন কোনো প্রয়াস এখনো চোখে পড়েনি।

নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, 'আন্দোলনের মূল হোতাদের গ্রেপ্তার করো, দাঙ্গাবাজদের খুন করো এবং তাদের লাশ গুম করো।'
কিন্তু গত বছরের জুলাই-আগস্টে কতজন আন্দোলনকারীর লাশ গুম হয়েছে, তা এখনো বের করতে পারেনি বর্তমান প্রশাসন।
দ্য ডেইলি স্টার মোট ৩১টি অজ্ঞাত মরদেহের ব্যাপারে অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত অনেক নথি ও প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে, গুম হওয়া লাশের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকারীদের হত্যা ও গুম করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নামফলকহীন কবরের সারি
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বাংলাদেশের একমাত্র সংস্থা যারা অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন করে থাকে। নথি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫১৫টি লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান, অর্থাৎ মাসে গড়ে দাফন হয়েছে ৪৭ লাশ।
তবে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে লাশের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
জুলাইয়ের শেষ ১০ দিনেই দাফন হয়েছে ৪৫ লাশ, যা আঞ্জুমানের মাসিক গড়ের প্রায় সমান।
কিন্তু সংস্থাটি জানায়, আগস্টের ১ থেকে ১১ থেকে তারিখ পর্যন্ত একটিও লাশ দাফন করেনি তারা। যদিও ২ থেকে ৫ আগস্টে আন্দোলনকারীদের ওপর সবচেয়ে বেশি দমন-নিপীড়ন চলেছে। মাসের শেষ ২০ দিনে তারা ৩৪টি লাশ দাফন করেছে।

২৯ জানুয়ারি রায়েরবাজার কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, চার নম্বর ব্লকে সারি সারি অনেকগুলো করব যেগুলোর সামনে কোনো নামফলক নেই। কবরস্থানের কর্মীদের মতে, এখানেই দাফন হয়েছেন জুলাই শহীদরা।
আঞ্জুমান ও রায়েরবাজার কবরস্থানের নথি অনুযায়ী, জুলাই ও আগস্টে কবরস্থানের এই ব্লকে মোট ১১৪টি মরদেহ দাফন হয়েছে।
তবে এর মধ্যে মোট ৪০টি অজ্ঞাতনামা লাশের মৃত্যুর তারিখ ১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে। ৪০ জনের মধ্যে ২৭ জন জুলাইয়ে এবং ১৩ জন আগস্টে দাফন হয়েছেন।
সোহেল, ফয়সাল এবং আসাদুল্লাহ ছাড়া আরও তিন আন্দোলনকারী—রফিকুল ইসলাম (৫০), মাহিন মিয়া (২০) ও আহমেদ জিলানি (৩০) রায়েরবাজারে অজ্ঞাতনামা লাশ হিসেবে শায়িত আছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে দ্য ডেইলি স্টার।
আমাদের শনাক্ত করা এই ছয় আন্দোলনকারীই ১৮ থেকে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে নিখোঁজ হন। এবং তাদের নিখোঁজের স্থানও আন্দোলনের বিভিন্ন হটস্পট—যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, উত্তরা এবং মোহাম্মদপুরের আশেপাশে।
আহমেদ জিলানি বাদে সবাইকেই মৃত্যুর কয়েকদিনের মধ্যেই দাফন করা হয়। জিলানি ৩ আগস্ট নিহত হন, তাকে দাফন করা হয় ৩১ আগস্ট।
মোহাম্মদপুর থেকে নিখোঁজ হওয়া মাহিন মিয়াকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি পাঁচজনের মরদেহই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসে।
৩০ জানুয়ারি আমরা সোহেল রানার যাত্রাবাড়ীর বাসায় গিয়ে তার মা রাশেদা বেগমের সঙ্গে দেখা করি।
ছেলের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি সোহেলের একটি ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করেন।
'আমার সোহেল যে রাতে নিখোঁজ হইলো, আমি সারা রাত দরজা খোলা রাখছি। ভাবছিলাম রাতেই কোনো এক সময় ফেরত আসবে,' কাঁদতে কাঁদতে বলেন রাশেদা।
'সোহেল আর আসলো না। এখন ওর কবরটাও খুঁজে পাইনি আমরা।'