
ভোট এলে শুরু হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোটের খেলা। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কে কার সঙ্গে জোট বাঁধতে পারেÑ এ নিয়ে এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নানারকম আলোচনা, যোগ-বিয়োগের গুঞ্জন।
দেশের রাজনীতিতে অনেক বছর ধরেই মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কেন্দ্র করে ভোটের আগে জোটের খেলা চলে আসছে। তবে এবারের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েই প্রশ্ন রয়ে গেছে। তাই সঙ্গত কারণেই আলোচনা চলছে বিএনপির নেতৃত্বে কোনো জোট হচ্ছে কিনাÑ এ নিয়ে। আলোচনা চলছে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে নতুন জোট গঠন নিয়েও। এসব আলোচনায় যোগ হয়েছে ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জোট গঠন নিয়েও। এসব দল এককভাবে নির্বাচনি লড়াইয়ে নামবে, নাকি জোটবদ্ধ হয়েÑ এ নিয়ে চলছে নানারকম আলোচনা, হিসাব-নিকাশ।
প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে বড় দলগুলোর নেতৃত্বে ছোট ছোট দল জোট করে ভোটের মাঠে নামে। যার ফলে ছোট দলগুলো নিজেদের দলীয় প্রতীক বাদ দিয়ে বড় দলের প্রতীক নিয়ে ভোট করে থাকে। অতীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাম ঘরানার বেশকিছু দল জোট করেছিল। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ^াসী দলগুলোর একটি জোট ছিল। সেই জোটে ইসলামি দলগুলোর একটা বড় অংশও ছিল। এবার আওয়ামী লীগ না থাকলে জামায়াতে ইসলামের নেতৃত্বে ইসলামি দলগুলোর একটা জোটের সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জামায়াতের জোট গঠনের একটা প্রক্রিয়া এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি বরিশালের চরমোনাইয়ে গিয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে দেখা করেন জামায়াতের আমির। দীর্ঘদিন ধরে আদর্শিক বিরোধ থাকলেও দুই দলের নেতাই আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের পক্ষে সহমত পোষণ করেন। এটি রাজনীতির মাঠে আলোচনা তৈরি করে। এরপর গত ২৬ জানুয়ারি ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে গিয়ে চরমোনাই পীরের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাৎ ফের আলোচনায় উঠে আসে। এদিকে নতুন দল এনসিপিও বড় দলগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রাক্কালে জোটের সমীকরণ চূড়ান্ত হতে পারে। এখনও এ বিষয়ে কিছু বলার সময় আসেনি।
বিএনপির একটি সূত্রে জানা গেছে, এনসিপির নেতারা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা করেছেন। এনসিপি এখনও দেশব্যাপী তাদের কমিটি গঠন করতে পারেনি। দলটি প্রার্থী খুঁজতে দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় পরিচ্ছন্ন লোককে টার্গেট করছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পুরনো লোকরাও ভিড়তে পারেন বলে জানা গেছে। তবে এনসিপির সঙ্গে জোট বাঁধার বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি বলে সূত্রের খবর। সূত্র বলছে, আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে কোন দলের বিজয়ী হওয়ার সম্ভবনা, সেই ভাবনা মাথায় রেখেই জোটে ভিড়বে এনসিপি। তারা ঝুঁকি নিতে চায় না। দলটির লক্ষ্য, নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সংসদের প্রতিনিধিত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার বিদায়ের পর এ দলটির জোট-শরিকরাও নিষ্ক্রিয়। এর মধ্যে সক্রিয় হয়েছে ইসলামি দলগুলো। জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামি দলগুলো একটি বলয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য ইসলামি শাসনতন্ত্র কায়েম করা। আর বিএনপির লক্ষ্য জাতীয়তাবাদী চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে লালন করে যেসব দল রাজনীতি করতে চায়, তাদের নিয়ে আরেকটি বলয় তৈরি করা।
নির্বাচনে বিএনপি কোনো জোট করবে কিনাÑ এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচনে অনেক কিছুই হয়, সেটা দেখতে হবে। তবে ছাত্রদের সঙ্গে চূড়ান্ত কোনো আলাপ-আলোচনা আমাদের হয়নি। যুগপৎ আন্দোলনে যেসব দল ছিল, তাদের সঙ্গে আমরা জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করব, এটা দলীয়ভাবে নীতিগত সিদ্ধান্ত। তবে কারা করবে, কীভাবে করবে, তা পরিষ্কার হতে আরও সময় লাগবে। নির্বাচনের পর ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। জনগণ যদি আমাদের ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা বাস্তবায়ন করব, বলেন তিনি।
জোট প্রসঙ্গে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অবশ্য গত শুক্রবার বলেছেন, আমরা নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বিস্তারে মনোযোগী। জোট নিয়ে ভাবার সময় এখনও আসেনি।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বক্তব্যে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল। এ মুহূর্তে আমরা ৩০০ আসনে নির্বাচনের জন্য মাঠ ও প্রার্থী প্রস্তুত করার কাজে লেগে আছি। নির্বাচনের সময় ইসলামি দলগুলোর সাথে হোক আর অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে হোক ফ্যাসিবাদি চেতনার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে জোট গঠন হতে পারে। সেখানে দুই দল, পাঁচ দল বা ১০ দল হোক যে কোনো ঐক্যের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টা করবে জামায়াত।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ আমাদের সময়কে বলেন, জোট নিয়ে এখনো কোনো আলাপ হয়নি। নিজ দলের যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঈদের পর এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে মাঠে নামব।
জোটের সমীকরণ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, নতুন দল কোনো জোটে যাবে কিনা, সেটা এখনও জানা যায়নি। তবে বর্তমানে ভোটের মাঠে যেসব দল রয়েছে, তাদের ভেতর ঐক্যের সুর রয়েছে। ঐক্য থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে কীভাবে? ঐকমত্য হলে প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে জোট-মহাজোটের বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে তবে জোটের হিসাব পাল্টে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিএনপির জোটে জামায়াত যুক্ত হলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
এদিকে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একটি জরিপ করেছে ইনোভিশন কনসাল্টিং নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ‘জনগণের নির্বাচন ভাবনা : ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২৫‘ শীর্ষক জরিপের তথ্যে উঠে এসেছে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর অবস্থান। এতে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দেশ ছেড়ে পালালেও এখনও ভোটারের একটি অংশ মনে করে দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগের ভোটে থাকা উচিত। তবে তাদের অবস্থান এখন অনেকটাই নিম্নমুখী। প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামের নিচে নেমে এসেছে আওয়ামী লীগ।
জরিপে দেখা গেছে, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে কোন দলকে ভোট দেবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ৬৫ শতাংশ ভোটার তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে ৪২ শতাংশ বিএনপিকে সমর্থন করেছেন, ৩২ শতাংশ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে মত দিয়েছেন আর আওয়ামী লীগ পেয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।
জরিপে উঠে এসেছে, পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা এখনও টিকে থাকলেও তরুণ ভোটারদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দলকে সামান্য ব্যবধানে পেছনে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। জেন-জি ভোটারদের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১১ শতাংশ সমর্থন; তরুণদের রাজনৈতিক দল পেয়েছে ১০ শতাংশ। তবে সামগ্রিকভাবে এ তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আদায় করতে পেরেছে।
গত দেড় যুগ ধরে বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতসহ বর্তমানে রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় দলগুলো একত্র হয়ে রাজনীতি করেছে; তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ছিল অভিন্ন। তাই সামনের নির্বাচনে জোটের সমীকরণ নিয়ে আগাম ধারণা পাওয়া কঠিন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অনেকে মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না থাকলে জোটগত নয় বরং বড় দলগুলোর একক লড়াইয়ের সম্ভাবনাই বেশি।