
সেই সূত্রে দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডাকতেন ‘ফুফু’ বলে; আইজিপি বেনজীর আহমেদ ‘কাজিন’ আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ছিলেন তার কাছে ‘চাচা’। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি গড়েছেন বিপুল সম্পদ।
কিছুদিন আগেও চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ছিলেন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি, আর সেই প্রভাব তিনি খাটিয়েছেন নানা ক্ষেত্রে; এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও বিস্ময়করভাবে তার স্বার্থ রক্ষা করে গেছে।
অথচ ১৯৯৯ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল সাধারণ একজন ব্যাংকার হিসেবে। সেখানে চাকরিরত অবস্থায় আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক হলে বিতর্কের মুখে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চাকরি ছাড়েন তিনি।

চৌধুরী নাফিজ সরাফাত
২০০৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নামে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির লাইসেন্স নেন। সেখান থেকে শুরু হয় তার উত্থান।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে আর্থিক খাতের অনিয়মে বারবার নাফিজ সরাফাতের নাম এলেও তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী অনেক ব্যবসায়ীর মত নাফিজ সরাফাতের বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু করে। তার বিরুদ্ধে তদন্তে নামে অর্থপাচার প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
গত অগাস্টেই নাফিজ ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়। এক সময় যাকে স্পর্শ করা যেত না এবং অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হলে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখানো হত, সেই নাফিজ সরাফাত গা বাঁচাতে পাড়ি জমান বিদেশে।
প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধানে ৫২টি কোম্পানিতে তার ও তার পরিবারের বিনিয়োগের তথ্য খুঁজে পেয়েছেন তদন্তকারীরা।

উত্থানের শুরুটা শেয়ারবাজারে ফান্ড ম্যানেজমেন্ট দিয়ে হলেও গত দেড় দশকে নাফিজ হোটেল, বিদ্যুৎ, মোবাইল টাওয়ার, আবাসন, মিডিয়া, অ্যাগ্রো, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
কানাডা বাংলাদেশ চেম্বার হাউসের (কানাডা) সভাপতি নাফিজ সরাফাত কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব ও আর্মি গলফ ক্লাবের সদস্য, ওয়ার্ল্ড চেজ ফেডারেশনের (বাংলাদেশ বিভাগ) সহসভাপতি, এমনকি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতিরও সদস্য পদে আসীন হয়েছিলেন তিনি।
বলা হয়, মাত্র দেড় দশকে নাফিজের এই বিপুল সাফল্যের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য, যার মাধ্যমে তিনি অনিয়ম করেও পার পেয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গে নাফিজ সরাফাতের সম্পর্কের কথা ব্যাংক ও পুঁজিবাজার খাতের সবারই জানা।
তার বিষয়ে অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত দুদকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নামে বেনামে যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই নাফিজ সরাফাত কোম্পানির অংশীদারত্ব নিয়েছেন। কখনো অর্থের বিনিময়ে, কখনো ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।
“এখন পর্যন্ত ৫২টি কোম্পানিতে তার বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশে-বিদেশে তার স্থাবর সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। আরও যাচাই-বাছাই চলছে। এই তালিকায় তার সম্পদের পরিমাণ আরো বাড়বে। তার বা তার পরিবারের মালিকানায় সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া মাত্র সেগুলো আদালতে জব্দের আবেদন করা হবে, যাতে তিনি সেগুলোর মালিকানা হাতবদল করতে না পারেন।”

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশ সফরে নাফিজ সরাফাতও সঙ্গী হয়েছেন একাধিকবার।
নাফিজ যেখানে অংশীদার
• এআইফাইভ টেক সার্ভিসেস লিমিটেড
• আরগাস মিডিয়া সার্ভিসেস লিমিটেড
• আরগাস রিসার্চ (বিডি) লিমিটেড
• আরোসা জনশক্তি লিমিটেড
• বাংলাদেশ (বিডি) রেইস লিমিটেড
• বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস
• বাংলাদেশ ক্যাপিটাল ডেভলপমেন্ট লিমিটেড
• বাংলাদেশ রেইস ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড
• কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইমারি স্কুল অব বিডি লিমিটেড
• কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
• গার্ডেনিয়া অয়ার্স লিমিটেড
• গ্লোবাল এনার্জি লিমিটেড
• হীরা ক্যাপিটাল ম্যানেন্টে (বিডি) লিমিটেড
• আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসি
• লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এলআইসি) অব বাংলাদেশ লিমিটেড
• লুমিন্যাস ইক্যুয়িটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড
• মেসার্স সাজেদা চৌধুরী মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
• মিল্ক ওয়েভ ডেইরি লিমিটেড
• মৌ ভ্যালি লিমিটেড
• ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেড
• নিউ এজ আইটি সল্যুশন (প্রা.) লিমিটেড
• নিউজ বাংলা মিডিয়া লিমিটেড
• দৈনিক বাংলা লিমিটেড
• সিটিজেন টেলিভিশন লিমিটেড
• পদ্মা ব্যাংক পিএলসি
• পদ্মা ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড
• রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট
• রয়্যাল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা ট্রাস্ট
• সিডিনেট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড
• কপারটেক ইন্ড্রাসট্রিজ লিমিটেড
• ক্রিম অ্যান্ড মিল্ক লিমিটেড
• ডিমিটার ডিজিটাল ডিফেন্স লিমিটেড
• ডাইনেস্টি হোমস লিমিটেড
• ফিনেক্স সফটওয়্যার লিমিটেড
• ফ্রন্টটিয়ারস ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড
• এস অ্যান্ড টি ট্রেডিং (প্রা.) লিমিটেড
• এসফোর নেস্ট ডেভলপমেন্টস লিমিটেড
• সারাক্ষণ মিডিয়া লিমিটেড
• এসএফআইএল ফাইন্যান্স পিএলসি
• এসএফএল হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড
• এসএফএল ইউনিক নির্ব্রাস মেঘনাঘাট পাওয়ার পিএলসি
• শান্তিনিকেতন প্রপার্টিজ লিমিটেড
• সিঙ্গেল ক্লিক আইটি সলিউশন (প্রা.) লিমিটেড
• সফটহরাইজন (প্রা.) লিমিটেড
• সোনারগাঁও ইকোনমিক জোন লিমিটেড
• সাউথইস্ট ব্যাংক পিএলসি
• স্টার ইনফ্রাস্ট্রাকচার কনসোর্টিয়াম ডেভলপমেন্ট লিমিটেড
• স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড
• স্ট্র্যাটেজিক ফাইনান্স লিমিটেড
• ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট পিএলসি
• জে অ্যান্ড জে এনার্জি লিমিটেড
দুদকের মহাপরিচালক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিংয়ের বিভিন্ন অভিযোগে অনুসন্ধান করছে দুদক। এরই মধ্যে তার নামে বেনামে বিপুল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।”
সরকার বদলের পর থেকে নাফিজ আছেন বিদেশে, অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বাড়ি, জমি ও ফ্ল্যাট ক্রোকের আদেশ
গত ৭ জানুয়ারি নাফিজ সরাফত ও তার পরিবারের বাড়ি, জমি ও ১৮টি ফ্ল্যাট ক্রোকের আদেশ দিয়েছে আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর দায়রা জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।
যেসব সম্পদ ক্রোকের আদেশ হয়েছে তার মধ্যে নাফিজের নামে গুলশানের ২০ তলা একটি বাড়ি রয়েছে। তার ফ্ল্যাট রয়েছে, গুলশানে একটি, ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকায় চারটি, নিকুঞ্জ উত্তর আবাসিক এলাকায় একটি ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের ৫০ শতাংশ।
প্লট রয়েছে নিকুঞ্জে দুটি, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১০ কাঠা করে দুটি, রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সাড়ে ৭ কাঠার একটি। এছাড়া বাড্ডার কাঁঠালদিয়ায় আড়াই কাঠা, গাজীপুর সদরে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ, জোয়ার সাহারায় ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ জমি রয়েছে তার।
নাফিজের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা সাহিদের নামে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে সাত কাঠা জমির ওপর চারতলা বাড়ি, পান্থপথে একটি, গুলশান লিংক রোডে একটি, মিরপুর ডিওএইচএসে একটি, শাহজাদপুরে একটি ফ্ল্যাট এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের ৫০ শতাংশ। এছাড়া তার নামে নিকুঞ্জে তিন কাঠা জমি, বাড্ডার কাঁঠালদিয়ায় আড়াই কাঠা নাল (আবাদি) জমি ও গাজীপুর সদরে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ চালা (উঁচু) জমি রয়েছে।
তাদের ছেলে চৌধুরী রাহিব সাফওয়ান সরাফাতের নামে থাকা বনানীর তিনটি ও বারিধারার চারটি ফ্ল্যাট জব্দেরও আদেশ দিয়েছে আদালত।
দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রধান উপপরিচালক মাসুদুর রহমান আদালতে নাফিজ সরাফাত ও তার পরিবারের এসব স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আবেদন করেন।
আবেদনে তিনি বলেন, নাফিজ, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা ও তার ছেলে রাহিবের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাবর সম্পত্তির তথ্য পাওয়া গেছে এবং তারা পলাতক রয়েছেন।
“দুদক অনুসন্ধান শুরু করার পর নাফিজ সরাফাত ও তার পরিবারের সদস্যদের সব স্থাবর সম্পত্তি অন্যদের কাছে হস্তান্তর, স্থানান্তর, বন্ধক বা বেহাতের প্রচেষ্টা চালানো হয়। সে কারণে এসব সম্পত্তি জব্দ করা প্রয়োজন।”
গত ২২ জানুয়ারি নাফিজ সরাফাতের দুবাইয়ে থাকা একটি ফ্ল্যাট ও একটি ভিলা জব্দের আদেশ দেয় আদালত।
গত বছরের ১৭ অক্টোবর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হলেও সেদিন তিনি দুদকে হাজির হননি। ই-মেইল মারফত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বিদেশে অবস্থানের তথ্য তিনি জানিয়েছিলেন।
সবশেষ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দুদকের আবেদনে নাফিজ সারাফত, স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহিদ ও ছেলে চৌধুরী রাহিব সাফওয়ান সারাফাতের ৭৪টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেয় আদালত।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, নাফিজ সারাফত ও অন্যদের বিরুদ্ধে ‘ঘুষ, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও নিজেদের মাধ্যমে একে অপরের যোগসাজশে’ প্রায় ৮৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।
“চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, স্ত্রী আজুমান আরা শহিদ ও পুত্র রাহিব সাফওয়ান চৌধুরীর নিজ নামে এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে তাদের পেশা, অর্থের উৎস ও হিসাব খোলার উদ্দেশ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিপুল অঙ্কের টাকা জমা ও উত্তোলনের তথ্য পাওয়া যায়। তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে যা অসংগতিপূর্ণ ও এই বিপুল পরিমাণ ব্যাংক লেনদেন মানিলন্ডারিংয়ের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানকালে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।”

চৌধুরী নাফিজ সরাফাত
পুঁজিবাজারের প্রভাবশালী নাম
চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ২০০৮ সালে রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পিসিএল নামে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির লাইসেন্স নেন। তার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিলেন হাসান তাহের ইমাম। সে সময় কোম্পানিতে নাফিজের মালিকানা ছিল ২৪ দশমিক ২৫ শতাংশ, বাকিটা হাসান তাহের ইমামের।
২০১৩ সালের মধ্যেই ১০টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায় রেইস। বর্তমানে এ কোম্পানির অধীনে ডিএসইতে লিস্টেড ১০টি ফান্ড রয়েছে। মেয়াদী ও বেমেয়াদী এসব ফান্ডের আকার আড়াই হাজার কোটি টাকার মত।
২০১৯ সালেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, সে সময় রেইস পরিচালিত ১০টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর কমতে কমতে অভিহিত মূল্যের অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ খাতে রেইসের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি বলেও খবর প্রকাশিত হয়।
এর পুরোটাই বিনিয়োগ করা হয়েছে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিতে, যেখান থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী রেইসের ব্যবস্থাপনায় থাকা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকারীরা এখন লোকসানে আছে।
রেইসের হাতে থাকা ১০টি ফান্ডের সর্বোচ্চ মেয়াদ ১০ বছর ছিল। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এগুলোর অবসায়ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, নাফিজ সরাফাতের তদবিরে মেয়াদ আরও ১০ বছর বাড়ানো হয়েছে।
মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা লঙ্ঘন করে নিজেদের ব্যবস্থাপনাধীন ফান্ডের মাধ্যমে ব্লক মার্কেটে বড় ধরনের লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে রেইসের বিরুদ্ধে। সে কারণে গতবছর ৪ জুলাই রেইসের ব্যবস্থাপনাধীন ফান্ডগুলো ব্লক মার্কেটসহ সব ধরনের লেনদেন স্থগিত করে বিএসইসি। এতে বন্ধ হয়ে যায় এসব ফান্ডের সব ধরনের লেনদেন।

এর আগে জুন মাসে রেইসের সব বিও অ্যাকাউন্টে লেনদেন স্থগিত করা হয়; তাদের পরিচালনাধীন সব মিউচুয়াল ফান্ডের বিও অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট ট্রাস্টিদের।
সবশেষ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ দুটি সিদ্ধান্ত বিএসইসি প্রত্যাহার করে নিলে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পুনরায় মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর লেনদেন শুরু হয়।
বিএসইসি এক সার্কুলার দিয়ে বলেছে, ২০২৪ সালের ২৪ জুন ও ৪ জুলাই দেওয়া সিদ্ধান্ত দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। এ দুটি সার্কুলার ছিল রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ডের লেনদেন, রেইসের সব বিও অ্যাকাউন্টে লেনদেন স্থগিত করা ও তাদের পরিচালনাধীন সব মিউচুয়াল ফান্ডের বিও অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে ট্রাস্টিদের নির্দেশ সংক্রান্ত।
অন্যদিকে ২০২৪ সালের জুন ও জুলাই মাসে রেইসের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনে দুটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএসইসি।
বিও হিসাব স্থগিত ও তদন্তসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায় রেইস। বিএসইসির সিদ্ধান্তের বিষয়ে উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ দিলেও আবেদনের শুনানি চলছে।
এরপর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রেইসের ওপর চলমান থাকা তদন্ত কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
তদন্ত বন্ধের বিষয়ে ওই সময় বিএসইসির মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় আছে। এজন্য আইনি দিকগুলো পর্যালোচনা করে কমিশন তদন্ত চালিয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
এ বিষয়ে রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চিফ কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা (সিসিও) এ কে এম মামুনুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই।’’
মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটপ্রতি সম্পদ মূল্যর সমান অঙ্কে লেনদেন হলে বিনিয়োগকারীর লোকসান হয়। আর রেইস পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ডের এনএভি এর অনেক নিচে হাতবদল হচ্ছে।

নাফিজ বলতেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ তার কাজিন।
এ বিষয়ে রেইসের সিসিও মামুনুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারের মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর মোট সম্পদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন তদন্তের আওতায় আটকে ছিল। সম্পদের আকার বিবেচনায় রেইস পরিচালিত ফান্ডের সম্পদই হচ্ছে ৫০ শতাংশ। আমাদের লেনদেনও বন্ধ ছিল দীর্ঘ সময়।”
তিনি বলেন, “মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করা হয় দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগের জন্য। কিন্তু ডিভিডেন্ড দেওয়ার পরপরই ফান্ড কেনা-বেচা বেড়ে যায়। এর প্রভাবে ফান্ডের সম্পদ মূল্য ও ইউনিট প্রতি বাজার মূল্যের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে, যেখানে বাজার মূল্য এখনো অনেক কম।”
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে নাফিজ সরাফাত বেস্ট হোল্ডিংসের আইপিও ডিরেক্ট লিস্টিংয়ের অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার সুপারিশ আদায় করেছিলেন। প্রথমবার সফল হতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের মাধ্যমে তিনি বেস্ট হোল্ডিংসকে তালিকাভুক্ত করাতে সক্ষম হন।
নাফিজ বেস্ট হোল্ডিংসের প্লেসমেন্ট শেয়ার সাবেক আইজিপি বেনজীরের দুই মেয়ের নামে বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বলেও খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে।

তেলেসমাতি ব্যাংক খাতেও
রেইস পরিচালিত ফান্ডের অর্থ থেকে ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংকে (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ৭০ কোটি ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমেই ব্যাংকটির পরিচালক বনে যান নাফিজ সরাফাত। পরে তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের তালিকায় নাফিজের স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদও ছিলেন।
অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত; পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম হয় পদ্মা ব্যাংক।
পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-এর মাধ্যমে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেওয়া হয়, যা ওই সময়ে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ। সেই বিনিয়োগ থেকে ব্যাংকগুলোর কোনো লাভ হয়নি, বরং দিনে দিনে পদ্মা আরো ডুবেছে।
২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের শেষে তা বেড়ে ৩ হাজার ৬৭২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়, যা মোট ঋণের প্রায় ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ নাফিজ সরাফাতের সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০২ কোটি টাকা।
এই পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নাফিজ সরাফাতকে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে হয়। পরে পদ্মাকে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক মার্জারের উদ্যোগ ঝুলে গেলে পদ্মার ভবিষ্যতও ঝুলে যায়।

চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে নিয়ে আহমেদ কবীর কিশোরের আঁকা সেই কার্টুন।
২০২১ সালে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরের আঁকা একটি কার্টুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তোলে। চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে চিত্রায়িত করা ওই কার্টুনে নাভির জায়গায় দেখা যায় ব্যাংকের প্রতীক সিন্দুকের হাতল। তাতে ক্যাপশন ছিল, “আমি চৌ নাফিজ সারাফাত/জানি ব্যাংক খাওয়ার ধারাপাত!”
সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনায় বলা হয়, কিশোরের আঁকা ওই কার্টুনের উপরের ক্যাপশনটি লিখেছিলেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মুশতাক আহমেদ।
ওই বছর মে মাসে ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে মুশতাক, কিশোরসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বারবার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারে মৃত্যু হয় ৫৩ বছর বয়সী মুশতাকের। আর কিশোর জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তার ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন।

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির নামে প্লটে অনিয়ম
নাফিজ সরাফাত ছিলেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত, যিনি পরে সংসদ সদস্য ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী হন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিকে ১৭১ দশমিক ১৬ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দেয় রাজউক। ওই প্লট দেওয়ার ক্ষেত্রে পরে নিয়ম ভাঙা হয়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে শ্রেণি পরিবর্তন করে প্লটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বরাদ্দ দেওয়ার কারণও মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছিল।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মূল অনুমোদিত নকশায় এ প্লটকে ‘সেকেন্ডারি স্কুল’ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। নাফিজ সরাফাতের আবেদনে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্লটের শ্রেণি ‘সেকেন্ডারি স্কুল’ পরিবর্তন করে ‘কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়’ করার প্রস্তাব রাজউক অনুমোদন করে।
বিষয়টি নজরে আসার পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজউকের চেয়ারম্যানকে এই প্লট বরাদ্দ নিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়।
সেখানে বলা হয়, “রাজউকের চতুর্থ সংশোধনী পর্যন্ত এবং ৫ম সংশোধনীর প্রস্তাবিত আইকনিক টাওয়ার অংশটুকু মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগের আদেশে বহাল রাখা হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনীর আইকনিক টাওয়ার ছাড়া অবশিষ্ট অংশ এবং পরবর্তী পরিবর্তনসমূহ উল্লিখিত আদেশের প্রেক্ষিতে মহামান্য উচ্চ আদালত কর্তৃক গৃহীত হয় নাই বিধায় বাতিলযোগ্য।”
নাফিজ সরাফাতের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা সাহিদ চৌধুরী গুলশানের ১০৩ নম্বর সড়কে একটি প্লটের মালিক। ২০১৭ সালে সেটিকে বাণিজ্যিক প্লট করার আবেদন করলে ‘গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে’ রাজউক তাতে অনুমোদন দেয়। অথচ তার আগে রাজউক ওই আবেদন ফিরিয়ে দিয়েছিল প্লটটি ‘বাণিজ্যিক ব্যবহারের আওতাভুক্ত নয়’ বলে।