Image description
জোবায়ের আল মাহমুদ
বিএনপির নেতারা নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির প্রস্তাবিত সেকেন্ড রিপাবলিক এর বিরোধিতা করা শুরু করেছেন। কেউ বলছেন সেকেন্ড রিপাবলিক আবার কি জিনিস? প্রথম রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে যে আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক দরকার? বিএনপি নেতারা সেকেন্ড রিপাবলিক এর দাবিকে এখন নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার কৌশল বলেও এর বিরোধিতা করছেন। বিএনপি যে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট বা গণ-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন তার প্রমাণ তারা জুলাই প্রক্লেমেশন এবং তার ভিত্তিতে নতুন গঠনতন্ত্র ও সেকেন্ড রিপাবলিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। উনারা মনে করছেন চলমান সংবিধানের কিছু সংস্কার করলেই সব ওকে হয়ে যাবে। ৭২ এর সংবিধান রক্ষার দাবিতে এখন বিএনপি, লীগের বুদ্ধিজীবী এবং ভারত এক জোট হয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাতের জন্যই এই এলায়েন্স কিনা তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
 
জুলাই ঘোষণাপত্র বাদ দিয়ে ৩১ দফা নিয়ে বিএনপি আগাতে চায়, এই ৩১ দফা জুলাই বিপ্লবের আগে দেওয়ার ফলে তাতে জুলাই বিপ্লবের গণ-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগই কম যেমন ৩১ দফাতে সংসদীয় সার্বভৌমত্ব/রাষ্ট্র বা সরকারের সার্বভৌমত্বই বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে, গণ-সার্বভৌমত্ব (people's sovereignty) অথবা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। অথচ আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে গণ-সার্বভৌমত্ব সেটা মার্কিন বুর্জোয়া বিপ্লব এবং ফ্রেন্স রিভলুশনেরই মূলসুর। ২৪ এর এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থানের পর তার একটা প্রক্লেমেশনের ভিত্তিতেই তো সামনের রাজনীতি আবর্তিত হওয়ার কথা অথচ জুলাই বিপ্লবের ১ বছর আগে দেয়া তাদের সংস্কার প্রস্তাবের ভিত্তিতেই আগাতে চায় যেটা জুলাই বিপ্লবকে যে বিএনপি অউন করতে চায় না তারই প্রমান।
বিএনপির ৩১ দফা তে রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মাঝে পাওয়ার শেয়ারের প্রস্তাব থাকলেও সংবিধানের মেইন পাওয়ার ডায়নামিক্স এবং ভাবাদর্শ একই রেখে দায়সারাভাবে সংস্কার এর কথা বলা আছে ফলে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার সিস্টেম অথবা সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার সিস্টেম অক্ষত রাখার প্রকল্প ৩১ দফা। দায়সারা গোছের বলছি যেমন ৭০ অনুচ্ছেদ পুরা বাতিলের কথা না বলে সংশোধের কথা বলা হয়েছে যেখানে আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন সব ক্ষেত্রে সাংসদ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না ফলে সাংসদের নিজস্ব স্বাধীনতা মানে তিনি যেই নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধি সেখানকার জনগণের মতামতকে দলীয় বাক্সে বন্দী করার গণতন্ত্র বিরোধী প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে।
 
২৪ এর জুলাই বিপ্লব হয়েছে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ ও কলনিয়াল আধিপত্য এর বিরুদ্ধে। ৩১ দফাতে কিভাবে এই সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ এবং ইন্ডিয়ার হেজেমনিক আগ্রাসন দূর করা হবে তার কোন সুস্পষ্ট রূপরেখা নাই।২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যেভাবে ছাত্র-জনতার উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে নিপীড়ক বাহিনী হিসেবে র্যাব ও ডিজিএফআই এর বিলুপ্তি এবং পুলিশ বাহিনীর ব্যাপক সংস্কার দরকার। বিএনপির ৩১ দফাতে গুম খুন হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা বলা হলেও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ক বাহিনীর বৈপ্লবিক সংস্কার/ পুনর্গঠনের কোন কথা নাই। জননিপীড়ক আমলাতন্ত্রের যথাযথ সংস্কারের কোন স্পেসিফিক কিছুই সেখানে নাই।
 
ফলে ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে আগানো মানে দায়সারা গোছের সংস্কার করে ফ্যাসিস্ট সিস্টেম ও কাঠামো অক্ষত রেখে রাজনীতি করতে চায় তারা। ফলে ৭২ এর সংবিধানের হাল্কা সংস্কার করে তারা চলতে চায়। যেই সংবিধান এর উপযোগিতা বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নাই, যা বার বার আমাদের বাকশাল, সামরিক শাসন, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র এবং সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে গেছে সেই সংবিধানকে জোড়াতালি দিয়ে আর চালানো যাবে না কারন এটা আবার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হবে। তাই ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের দাবি হচ্ছে এই সংবিধান বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা। অথচ বিএনপি এখন লীগ আর ভারতের বয়ান ফেরি করে বলছে ৭২ এর সংবিধান এর মূল কাঠামো অক্ষত রাখতে হবে এবং না হলে নাকি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হবে। অথচ গণপরিষদ না করেই পাকিস্তানি কাঠামোর ভিত্তেই গড়ে উঠা যেই গণপরিষদ তার ভিত্তিতে ৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন করা হয় যেখানে সংসদ/সরকারকেই সার্বভৌম পাওয়ার দেয়াতে এবং স্টেটের তিন বিভাগের মাঝে পাওয়ারের কোন ব্যাল্যান্স না থাকায় ( সেপারেশন অব পাওয়ার না থাকায় এটা কোন রিপাবলিকই হয়নি) এবং ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে একজন সাংসদের নিজ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার অধিকার কেড়ে নেয়ায় এই সংবিধানের যেই পাওয়ার স্ট্রাকচার দাঁড়িয়েছে তাতে নির্বাহী বিভাগের প্রধানের কাছে একক কেন্দ্রীভূত পাওয়ার থাকায় একটা ভয়াবহ একনায়কতান্ত্রিক কাঠামোই হচ্ছে এদেশের শাসনতন্ত্র। ফলে এই সংবিধান মাত্রই একটা সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র বা পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র এর বাইরে আর কিছুই আমাদের উপহার দিতে পারেনি এবং পারবে না। ফলে এই সংবিধানই আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। এ কারনে ৭২ এর সংবিধান হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের যে গণদাবি মানে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবিপ্লব।
 
অথচ ৭২ এর সংবিধানে যে গণ-সার্বভৌমত্ব নাই তাই এটাই যে মুক্তিযুদ্ধকে বেহাত করার প্রথম সাইন ছিল তা উনারা জনগনকে জানতে দেন না। ফলে ৭২ এর সংবিধান আমাদের রাষ্ট্র গঠন করতে দেয়নি এবং গণতন্ত্র হয়ে গেছে সুদূরপরাহত। এই সংবিধানের পক্ষে লিগ, লিগ ঘেঁষা বামপন্থি আর ভারতের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের/মিডিয়ার এত কান্নাকাটি মূলত একে কেন্দ্র করে নিজেদের হেজিমনিক পাওয়ার চর্চা এবং দেশকে ভারতের অধীনে রেখে একটা ভ্যাসাল স্টেট কাঠামো বজায় রাখার পক্ষে অকালতি ছাড়া আর কিছুই না। এই গোষ্ঠী এখন প্রচার করছে ৭২ এর সংবিধান বাতিল করলে নাকি দেশে ইসলামিক সংবিধান আসবে মানে 'ডানপন্থার' বা 'মৌলবাদের' উত্থান হবে এই জুজুর ভয় দেখিয়ে ভারত এবং লীগ যে প্রোপ্যাগান্ডা করছে বিএনপিও একই সুরে কথা বলছে। অথচ নতুন সংবিধানের মেইন ফোকাল পয়েন্ট হবে people's sovereignty and individual sovereignty মানে তা লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক স্টেট কাঠামোই প্রস্তাব করবে। নতুন গঠনতন্ত্র বাদ দিয়ে পুরানা সিস্টেমে চলার পক্ষে বিএনপির এই অবস্থান এর প্রেক্ষিতে অনেকেই ভাবছেন ভারতের সাথে কি বিএনপির কোন কনসেনসাস হয়েছে কিনা কারন এত বড় একটা বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের পরও গণক্ষমতার প্রতি আস্থা রেখে
people's sovereignty প্রতিষ্ঠার দিকে না গিয়ে বিএনপি কেন ইন্দিয়ান হেজিমনির মূল হাতিয়ার ৭২ এর অগণতান্ত্রিক সংবিধান সুরক্ষার কথা বলছে?
 
বিএনপির ৩১ দফা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে দেয়ায় এটা গণঅভ্যুত্থানের সব পক্ষের দফা নয়। ২০২৪ এর জানুয়ারির ইলেকশনের আগে আন্দোলন করার সময় ২০২৩ এর জুলাই এর ১৩ তারিখে যেই ৩১ দফা দেয়া হয় তা ছিল পুরানা রাজনৈতিক কাঠামোর ভিতর কিছু সংস্কার করে দায় সারার দাবি এবং সে কারনেই ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে কোন গণঅভ্যুত্থান হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের বয়ান নাই করে দেয়ার জন্য আবার বিএনপি ৩১ দফা নিয়েই আগাচ্ছে, জুলাই প্রক্লেমেশনের প্রাসঙ্গিকতা তারা অস্বীকার করছে ( সর্বশেষ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভার আলাপ)। ৩১ দফার সংস্কারের আলাপ ২৩ এর রাজনৈতিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে বিএনপির সীমিত সংস্কারের আলাপ এবং ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে কোন গণঅভ্যুত্থান হয়নি ফলে এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থানের পর জুলাই ঘোষণাপত্রকে বাদ দিয়ে ৩১ দফা নিয়ে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গণঅভ্যুত্থানকে রাজনীতি এবং ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত বলে আমি মনে করি। জুলাই প্রক্লেমেশন হাজির করা অতি জরুরি এ কারনেই। গণঅভ্যুত্থানের দলিল আকারে এবং গণঅভ্যুত্থানের জন- আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং কমিটমেন্ট রক্ষার চার্টার হিসেবে জুলাই প্রক্লেমেশন তাই অবশ্যই এই মুহূর্তের সবচেয়ে দরকারি রাজনৈতিক কাজ। এটাকে ঠেকিয়ে দিয়ে ৩১ দফার আলাপ আসলে দেশকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগের দশায় নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত।