Image description

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৮৭ জন পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের তালিকা করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তাঁদের মধ্যে দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্যদের চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় আরো কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা পালিয়ে গেছেন।

দিন দিনই বাড়ছে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তার সংখ্যা। এদিকে গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, যাঁদের মধ্যে হাসিনা সরকারের আমলের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা রয়েছেন।  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর পুলিশের কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে ১১ আগস্ট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন পুলিশকে ১৪ আগস্টের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার সময় নির্ধারণ করে দেন। এর আগে ৭ আগস্ট পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম পুলিশ সদস্যদের ৮ আগস্টের মধ্যে নিজ নিজ ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দেড় মাস পরও পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। পরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তাঁদের তালিকা করা হয়।

সূত্র মতে, ৫ আগস্টের পর নিরাপত্তার স্বার্থে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন ৫১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, অনেকে বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন আবার কেউ কেউ আত্মগোপনেও রয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে গত বছর নভেম্বরে জানানো হয়, পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য ছাড়া সবাই কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। তাদের তথ্যানুযায়ী, অনুপস্থিত থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ডিআইজি (উপমহাপরিদর্শক) রয়েছেন একজন, অতিরিক্ত ডিআইজি সাতজন, পুলিশ সুপার দুজন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একজন, সহকারী পুলিশ সুপার পাঁচজন, পুলিশ পরিদর্শক পাঁচজন, এসআই ও সার্জেন্ট ১৪ জন, এএসআই ৯ জন, নায়েক সাতজন ও কনস্টেবল ১৩৬ জন। এসব কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত শুধু ঢাকায় পুলিশের অন্তত ৯৯ জন কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর গতকাল রবিবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, পলাতকদের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নতুন করে কতজন পলাতক রয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। খোঁজ নিয়ে বলতে হবে।

সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসছে কোন কোন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলির নির্দেশ দিয়েছেন এবং কারা গুলি করেছেন। সেসব কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি যাঁরা বুঝতে পারছেন তাদের গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের কয়েকজন পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের কাছে পলাতক ১৮৭ জনের যে তালিকা তাঁদের মধ্যে  প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিএমপি) পুলিশের সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) বিপ্লব কুমার সরকার ও ডিএমপির ট্রাফিকের (দক্ষিণ) যুগ্ম পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্য ১৮৫ জনেরও চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে গত বছর ৫ আগাস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। তাঁর সরকারের সময় আইজিপি ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। সরকার পতনের পর তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে তিনি কারাগারে। ১৩ আগস্ট এসবির অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার (ডিআইজি পদমর্যাদার) মো. মনিরুজ্জামান ও পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল বাতেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তাঁদেরসহ এ পর্যন্ত ৩০ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।

পুলিশের পলাতক কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তাঁকে এখনো চাকরিচ্যুত করা হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হারুন অর রশীদ বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন আরেক পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলেছে, কাজে যোগ না দেওয়া শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেনডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার। আরপিএমপির উপপুলিশ কমিশনার মো. আবু মারুফ হোসেন, আরপিএমপি ডিবির উপপুলিশ কমিশনার মো. শাহ নূর আলম, ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান ও মো. ইফতেখার মাহমুদ, আরপিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান ও মো. আল ইমরান হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার রানা। পরিদর্শক পদে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া কর্মকর্তারা হলেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি মো. মাহফুজার রহমান, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক খাদেমুল বাহার বিন আবেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সার্কেলের পরিদর্শক মো. ইউসুফ হাসান, ডিএমপির পরিদর্শক জাকির হোসাইন ও ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন প্রমুখ। এরা সবাই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।