Image description
 

‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’, বৃহস্পতিবার নাম প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ছাত্রদের নিয়ে গঠিত এ নতুন রাজনৈতিক দলটি নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা, বিতর্ক এবং কৌতূহল। দলটি বড় কোনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে কিনা, তাদের পরিচিতি এবং নেতৃত্বের দিকগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, যেখানে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, দলটির অভ্যুদয়ের মধ্যেই ভেতরে যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা প্রকাশ্যে এসেছে। বিভিন্ন সময় দলের নেতা নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতা, মনোমালিন্য এবং সামাজিক মাধ্যমে পালটাপালটা বক্তব্যের লড়াই লক্ষ্য করা গেছে।

এছাড়াও, দলের শীর্ষ পদে যারা স্থান পাচ্ছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে জুলাই আন্দোলনের নেতারা, যা দলের রাজনৈতিক অবস্থান এবং নেতৃত্বের বিষয়ে আরও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে, দলের একাধিক রাজনৈতিক আদর্শের লোকদের একত্রিত করার পর, অনেকের ধারণা, দীর্ঘমেয়াদে ঐক্য বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

এই পরিস্থিতির মধ্যে, দলটির উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন নাহিদ ইসলাম, যিনি এখন দলের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

 

নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব কতটা গভীর?

ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যে নতুন রাজনৈতিক দল আনছেন, সেটার জন্য বেশ বড় আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ঢাকার সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউ।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বিবিসি বাংলাকে জানান, অন্তত দুই লাখ লোকের সমাগম ঘটিয়ে নতুন দল এবং শীর্ষ নেতাদের নাম ঘোষণা করা হবে।

সারজিস আলম বলেন, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি দুই লাখের মতো লোক সমাগম করতে। ঢাকার ভেতর থেকে যেমন অনেকে অংশ নেবেন, তেমনি ঢাকার বাইরে থেকেও নেতা-কর্মী-সমর্থকরা আসবেন।

দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

কিন্তু নতুন দলের নেতা কারা হবেন?

এক্ষেত্রে শীর্ষ পদগুলোতে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা প্রায় সবাই আন্দোলনের পরিচিত মুখ।

কিন্তু আন্দোলনে থাকলেও ব্যাপক পরিচিতি পাননি বা সেভাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি এমন নেতাদের নিয়ে আলোচনা কম।

নেতৃত্ব নির্বাচন কি ‘ফেসভ্যালু’ দেখে ঠিক করা হচ্ছে, নাকি সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে ঠিক করা হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়।

প্রক্রিয়াগত এসব জটিলতা সামনে এনে নতুন দলটিতে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক শিবির নেতা আলী আহসান জোনায়েদ। একইরকম ঘোষণা দিয়েছেন আরও দুই নেতা।

দল গঠনের আগমুহূর্তে দলটিতে নেতৃত্ব নিয়ে যে একটা দ্বন্দ্ব আছে সেটা স্পষ্ট। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব কতটা প্রশমিত হয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই বলেই মনে করেন তারা।

তিনি বলেন, আমরা আমাদের জায়গা থেকে এটাকে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব মনে করি না। বরং আমরা দেখেছি কে কোন জায়গায় পরিশ্রম করেছে, কে কোন জায়গা ডিজার্ভ করে, কেন ডিজার্ভ করে। এগুলো নিয়ে প্রত্যেকই তার জায়গা থেকে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। আমরা এভাবেই নেতৃত্বের জায়গাগুলো ঠিক করছি।

সারজিস আলম বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যে সিদ্ধান্ত আসবে, ধরেই নিলাম সেখানে পাঁচজন সন্তুষ্ট না। খুব স্বাভাবিকভাবে আমরা তখন প্রস্তুত বাকি পঁচানব্বই জন ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগুতে।

কিন্তু নেতা ঠিক করতে গিয়ে মতপার্থক্য কেন হচ্ছে? এমন প্রশ্নে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, মতপার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়।

তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে অনেক নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। সেই নেতৃ্ত্বের মধ্যে একটা অভ্যন্তরীণভাবে প্রতিযোগিতার বিষয় আছে। সেটাকে কোনোভাবেই আমরা মনে করি না যে সামনের দিনে এটা আমাদেরকে বড়ভাবে প্রভাবিত করবে। আমরা একত্রিত আছি এবং একতার ভিত্তিতেই সামনের দিকে এগিয়ে যাব।

দলে ভিন্ন আদর্শের লোক, সমাধান কীভাবে হবে?

ছাত্রদের নতুন দলে শীর্ষ পদে বসছেন উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করা নাহিদ ইসলাম। এর বাইরে পুরো দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় নানা মত, পথ ও রাজনৈতিক আদর্শের অনেকেই যুক্ত হচ্ছেন।

জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে ধর্মীয়, এমনকি রাজনীতিতে ধর্ম চান না এমন আদর্শের তরুণরাও আছেন এর মধ্যে।

বাংলাদেশে আদর্শভিত্তিক আলাদা আলাদা দল থাকলেও একই দলে সব আদর্শের সম্মিলন সেভাবে দেখা যায় না।

আবার রাজনীতিতে দলগুলোর আদর্শিক বৈরিতাও প্রবল।

ফলে নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব বড় কোনো বিভক্তির কারণ হবে না–– নেতারা এমনটা বললেও আদর্শিক বিভক্তির সমাধান তারা কীভাবে করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

তবে আদর্শিক বিভাজন এড়াতে সেক্যুলারিজম, ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ- এরকম কোনো আদর্শিক ধারার মধ্যেই ঢুকতে চায় না ছাত্ররা।

সারজিস আলম বলেন, আমাদের এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্ম হচ্ছে, এখানে থাকবে মধ্যপন্থার রাজনীতি। এখানে থাকবে বাংলাদেশপন্থা। এখানে নাগরিক পরিচয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদেরকে বাঙালি বলা হয়েছে, বাংলাদেশি বলা হয়েছে। এই সামগ্রিক বিষয়গুলোর মধ্যে আমাদের আসলে নাগরিক হয়ে ওঠা হয়নি। আমাদের মধ্যে এইযে বিভাজন বিভিন্ন ঘরানা, আদর্শের মধ্যে, আমরা সেটা সামনেই আনতে চাই না।

বোঝা যাচ্ছে, সম্ভাব্য নতুন দলটি প্রচলিত আদর্শিক তত্ত্ব কিংবা দ্বন্দ্বে ঢুকতে চায় না। বরং এটা থেকে দূরে থাকার কৌশল নিয়েছে। যার মূল কারণ ধর্মীয় বা অন্য কোনো ‘আদর্শিক বিভাজনের চক্রে’ না আটকানো।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলছিলেন, ‘এখানে বাম-ডানের বিভক্তি আছে। ধর্মীয় বিভক্তি আছে। এগুলো দিয়ে তো আমরা বাংলাদেশের মানুষকে একত্রিত করতে পারব না। বাংলাদেশের মানুষকে একত্রিত করতে হলে বাংলাদেশের জন্য যেসব কাজ আবশ্যক সেগুলোতে একমত হওয়া। সেটার জন্য আসলে কোনো দলীয় মতাদর্শ বা ব্যক্তি মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ না।’

তিনি বলেন, অ্যাজ এ স্টেট যদি এটাকে ডেভেলপ করতে হয় তাহলে কোনো মতাদর্শ জরুরি না। জরুরি হচ্ছে ক্রাইসিস বুঝতে পারা, মানুষের অধিকার বুঝতে পারা এবং সে অধিকারের জন্য যুদ্ধ করা।