
বিদেশি সহায়তানির্ভর বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর (এনজিও) কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও জবাবদিহিমূলক করতে অর্থছাড়ের প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। সংশোধিত পরিপত্রের মাধ্যমে এনজিও ব্যুরো, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রকল্প অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে, যা এতদিন এনজিওগুলোর অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছিল। নতুন নিয়মের ফলে প্রকল্প অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা দূর হবে এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় গতি আসবে।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এনজিওগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন খাতে এনজিওগুলো কাজ করছে। তবে এক দশকেরও বেশি সময় আগে জঙ্গিবাদে অর্থায়ন, অর্থ পাচার, ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বিদেশি অনুদানপুষ্ট এনজিওগুলোর কার্যক্রম কঠোর নজরদারিতে আনা হয়। এর ফলে শুধু অপতৎপরতায় জড়িত এনজিও নয়, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী এনজিওগুলোর কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়। বিদেশি অর্থায়নে কঠোর নিয়ম আরোপ করায় দাতা সংস্থাগুলোর অনুদান আসা কমে যায়, ফলে অনেক সংস্থাকে কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হতে হয়।
এনজিও ব্যুরো ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এনজিও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০১৬ সালে একটি আইন তৈরি করা হয় এবং ২০২১ সালে পরিপত্র জারি করা হয়। তবে সেই পরিপত্রের কিছু বিধি এনজিওগুলোর জন্য বাধার সৃষ্টি করেছিল। এনজিও কর্মী ও পরিচালকদের মতে, কঠোর বিধি ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প থমকে গিয়েছিল। এ অবস্থায় এনজিওগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর সরকার পরিপত্র সংশোধন করেছে, যা এনজিওগুলোর কার্যক্রমকে আরও সহজ এবং বিদেশি অর্থায়ন সংগ্রহের পথ সুগম করবে।
সংশোধিত পরিপত্র অনুযায়ী, এনজিও ব্যুরোতে জমা দেওয়া প্রকল্প প্রস্তাব ৪৫ দিনের মধ্যে অনুমোদন করতে হবে। আগের পরিপত্রে এ ধরনের নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। ফলে অনেক প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য ৬০ কার্যদিবস সময় থাকলেও নতুন নিয়ম অনুযায়ী সেটি ৪৫ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মতামত না দিলে সেটিকে অনুমোদনপ্রাপ্ত বলে ধরে নেওয়া হবে। একইভাবে, প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য ৩০ কার্যদিবস সময় থাকলেও এখন সেটি ৩০ দিন করা হয়েছে।
বিদেশি অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর জন্য আরেকটি বড় বাধা ছিল অর্থ ছাড়ের ধাপে ধাপে বিতরণ। আগে প্রথম ধাপে ৮০ শতাংশ অর্থ ছাড় করা হতো, পরবর্তী ২০ শতাংশ ছাড়ের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতো। এখন নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজন হলে একবারেই পুরো অর্থ ছাড় করা যাবে। তবে, প্রকল্পের সমাপ্তি প্রতিবেদনের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে। প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এনজিওগুলোর জন্য আরেকটি বড় সুবিধা হলো, কোনো কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়া অর্থ ছাড় বন্ধ করা যাবে না। আগে বিভিন্ন কারণে হঠাৎ করে অর্থ ছাড় স্থগিত করা হতো, যা এনজিওগুলোর প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াত। নতুন পরিপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্প অনুমোদনের জন্য জেলা প্রশাসকের অনুমোদন নিতে হবে এবং এটি ব্যুরোতে জমা দিতে হবে। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর জেলা প্রশাসক তার কার্যালয়ের প্রতিনিধির মাধ্যমে যাচাই করে প্রত্যয়ন দেবেন, যা ২০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
এনজিগুলোর কার্যক্রমের গতিশীলতা নিয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে পরিপত্রের কিছু ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। অবশেষে এটি সংশোধিত হওয়ায় আমরা আনন্দিত। আগে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দেরি হতো, ফলে দাতা সংস্থাগুলো বিরক্ত হতো। এতে অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা হতো। এখন সে সমস্যা দূর হবে।’
ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদ বলেন, ‘এনজিও প্রকল্প অনুমোদনে দুই থেকে আড়াই মাস লেগে যেত। অনেক সময় দাতা সংস্থাগুলো বরাদ্দকৃত অর্থায়ন ফিরিয়ে নিত। নতুন পরিপত্রের ফলে এসব দীর্ঘসূত্রতা দূর হবে এবং উন্নয়ন প্রকল্পের গতি বাড়বে।’
সরকারি দিক থেকে এনজিও কার্যক্রম তদারকির জন্য ২০১৬ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়। এরপর ২০২১ সালের পরিপত্রে কিছু কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তবে নতুন পরিপত্র এনজিওগুলোর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধন করা হয়েছে। এনজিও ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এনজিওগুলোর কার্যক্রম সহজ করতে এবং বিদেশি অনুদান পেতে দীর্ঘসূত্রতা দূর করতেই এই পরিপত্র সংশোধন করা হয়েছে। এতে এনজিওগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।’
বিদেশি অনুদানপুষ্ট এনজিওগুলোর জন্য এই পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এনজিও খাত বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। তবে এক যুগ আগে যখন এনজিওগুলোর অর্থায়নের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, তখন থেকে বিদেশি সাহায্য কমতে থাকে। বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুদান আরও কমে যায়। এনজিও ব্যুরো একসময় ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ হিসেবে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সেটি কার্যকর হয়নি। নতুন পরিপত্র সে সমস্যা কাটিয়ে তুলতে সহায়ক হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এনজিও ব্যুরোর সংশোধিত পরিপত্র বাস্তবায়ন হলে এনজিওগুলোর কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন নিয়মের ফলে প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থ ছাড়ের দীর্ঘসূত্রতা যেমন কমবে, তেমনি বিদেশি অনুদান সংগ্রহও সহজ হবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি শুধু এনজিওর জন্যই নয়, বরং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্যও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এখন দেখার বিষয়, নতুন নিয়ম কত দ্রুত কার্যকর হয় এবং এটি কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।