
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। প্রতিদিনই পুলিশের গুলিতে ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। ১৯ জুলাই নরসিংদীর ইটাখোলা মোড়ে শিক্ষার্থীদের ডাকে আন্দোলনে যোগ দেন মাঈন উদ্দিন। পুলিশের ছোড়া গুলিতে গুরুতর আহত হন।
একটি গুলি তার ডান হাত ভেদ করে বের হয়ে যায়। আরেকটি গুলি পেটের নিচের অংশে ঢুকে নাড়িভুঁড়ি ভেদ করে কোমরের পেছনের দিকে আটকে থাকে। এখনো তিনি কঠিন সংকটে নিপতিত। তার আরো চিকিৎসা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা।
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বাড়ৈই আলগী গ্রামের মিলন খানের ছেলে মাঈন উদ্দিন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন ২৪ বছর বয়সী এই টগবগে যুবক। চার বছরের একমাত্র মেয়ে রিদনী, স্ত্রী জেসমিন, বাবা মিলন খান ও মা উম্মে কুলসুমকে নিয়ে তার সংসার।
রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করেন তা দিয়েই চলত সংসার। ১৯ জুলাই সব তছনছ হয়ে যায়। তিনি জানান, নরসিংদীর ইটাখোলা মোড়ে শিক্ষার্থীদের ডাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। একপর্যায়ে তার হাত ও পেটে গুলি লাগে ।
আন্দোলনকারীদের কয়েকজন তাকে প্রথমে অর্থোপেডিক হাসপাতালে নেন। ওই রাতেই অর্থোপেডিক হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে মাঈন উদ্দিনের একটি অস্ত্রোপচার করা হয়। গুলিবিদ্ধ মাঈন উদ্দিনের পেটে গুলি লাগায় খাদ্যনালি একাধিক জায়গায় ছিদ্র হয়ে যায়। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মাঈন উদ্দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপনীত হন।
এ অবস্থায় তার পেটের খাদ্যনালির বেশ কিছু অংশ কেটে রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারির মাধ্যমে পেটের ডানপাশে মলত্যাগ করার জন্য কোলোস্টোমি ব্যাগ স্থাপন করা হয়। বেশ কিছুদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বাড়ৈআলগী নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।
পুনরায় তার পেটে ব্যথা শুরু হলে অসুস্থ বোধ করেন মাঈন উদ্দিন। এ কারণে তাকে ১২ আগস্ট নরসিংদী ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছয় দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার আশায় পুনরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
গত ২৩ অক্টোবর তার রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারির মাধ্যমে রিভার্সেল অব অ্যান্ড জেজুনোস্টমি ও কোলোস্টোমি ক্লোজার করা হয়। ফলে স্বাভাবিক নিয়মে মলত্যাগ করতে পারছেন মাঈন উদ্দিন।
পরে বিষয়টি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম এবং ডা. মাহমুদুল হাসান, তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কদের সঙ্গে মাঈন উদ্দিনের উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়। এতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানকে অবগত করেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগাযোগের ফলে প্রফেসর সালমা সুলতানার অধীনে মাঈন উদ্দিনকে ভর্তি করা হয়।
নরসিংদী জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ এন এম মিজানুর রহমান আমার দেশকে জানান, জেলা হাসপাতালে ভর্তির সময় তার দুর্বিষহ জীবন আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। তার পেটে ব্যথা, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক যে কষ্ট সেগুলো চিকিৎসকদের মনে হৃদয়বিদারক। মাত্র ২৪ বছর বয়সের এই তরুণ প্রতিনিয়তই তার ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করত আমাদের সামনে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন মুমূর্ষু রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য যতটুকু চেষ্টা করা দরকার তার কোনো কমতি করা হয়নি। মাঈন উদ্দিন আগের মতো ভারী কাজ করতে পারবেন না। তাকে সারা জীবনই কিছু নিয়মের মধ্যে চলতে হবে।
মাঈন উদ্দিনের স্ত্রী জেসমিন জানান, আমার স্বামী রিকশা চালিয়ে যা-ই পেত, তা দিয়ে কষ্ট করে হলেও পাঁচ সদস্যদের পরিবার চলত। তিনি সবার ছোট বলে তার সঙ্গেই বাবা-মা থাকেন। এখন তার চিকিৎসা করাব, না সংসারের খাবারের ব্যবস্থা করব, ভেবে পাচ্ছি না।
এরই মধ্যে সরকার থেকে কিছু পাওয়া সহায়তা দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি আর চাল কিনে আনছি। সামনে চলার কোনো উপায় দেখছি না। আমি কোথাও গিয়ে চাকরি করব তাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। আমাকেই সব সময় পাশে থাকতে হয়। এজন্য সরকারের কাছে সহায়তার দাবি জানান তিনি। যেন স্বামীকে সুস্থ করে ঘরে রেখে হলেও কোথাও গিয়ে চাকরি করে অন্তত খাবারের জোগাড় ও মেয়ের লেখাপড়াটা নিশ্চিত করা যায়।
মাঈন উদ্দিনের বাবা মিলন খান ছেলের এই অবস্থার বিষয়ে জানান, পরিবারের ছোট ছেলে ছিল মাঈন উদ্দিন। সে আমার সবচেয়ে আদরের হওয়ায় আমরা তার সঙ্গেই রয়ে গেলাম। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আল্লাহ বুঝি ছেলের রোজগার খেতে দেবেন না।
চিকিৎসকরা জানান, সে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না। আল্লাহ তার জীবন বাঁচিয়ে রেখেছেন এজন্য শুকরিয়া। পাশাপাশি তার আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশের ফ্যাসিবাদ দূর হয়েছে এতে আমি সন্তুষ্ট। তিনি তার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার জন্য সরকারের সহায়তা কামনা করেন।