
দেশের মহানগর ও আশপাশের এলাকাগুলোয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মহানগর এবং রেঞ্জের আওতাধীন এলাকাগুলোয় নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ও এর প্রতিকার চেয়ে করা মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
দেশের মহানগর ও আশপাশের এলাকাগুলোয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মহানগর এবং রেঞ্জের আওতাধীন এলাকাগুলোয় নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ও এর প্রতিকার চেয়ে করা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এসব এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকানো ও অপরাধ দমনকেই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে পুলিশ।
গণ-অভ্যুত্থানের পর ব্যাপক জনরোষের শিকার হয় পুলিশ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুলিশের ৪৬০টি থানা ও স্থাপনা। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় থানাগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক করে তোলার কাজ শুরু হয়। কাজে ফিরে আসে পুলিশও। তবে ছয় মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসেনি। বরং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর মতো এলাকাগুলোয় খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের ঘটনা বেড়ে গেছে। যদিও এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে এখনো কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি পুলিশ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জনসংখ্যা, সংশ্লিষ্ট এলাকার আয়তন এবং অপরাধের ধরনকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। অন্যথায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে সারা দেশে মোট মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৭২টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা রেঞ্জে ২ হাজার ৩৭৮টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক মামলা নথিভুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম রেঞ্জে ২ হাজার ১৯৯টি। এর পরের অবস্থানে থাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ১ হাজার ৭৯১টি। এরপর যথাক্রমে রাজশাহী রেঞ্জে ১ হাজার ৫৭৫টি, রংপুর রেঞ্জে ১ হাজার ৪৭৩, খুলনা রেঞ্জে ১ হাজার ৩৪৯, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৮৬৭, বরিশাল রেঞ্জে ৮৪৭ ও সিলেট রেঞ্জে ৭১১টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশকে তুলনামূলক কম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে রংপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশালে। জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে (সিএমপি) ৩৭১টি, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে (জিএমপি) ২৫৭, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে (কেএমপি) ১৭৮, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশে (আরএমপি) ১৬৬, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশে (এসএমপি) ১৪৬, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) ১৩২, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে (আরপিএমপি) ৭৪টি এবং রেলওয়ে রেঞ্জে ৫৮টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় এক ধরনের নিরাপত্তা সংকট। এ সুযোগে দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা এবং ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। হচ্ছে লুটপাটও। অনেক ক্ষেত্রেই উচ্ছৃঙ্খল জনতার মব সংস্কৃতির সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এ ধরনের অপরাধ তৎপরতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে দিনেদুপুরে ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও খুনের মতো অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে বেশি। এমনকি এসব অপরাধ দমন করতে গিয়ে উল্টো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আক্রান্ত হতে হচ্ছে। পুলিশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কার্যক্রম ভূমিকা রাখতে না পারলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ক্রমাগত হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। মানবাধিকার কর্মী এএসএম নাসির উদ্দিন এলান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের পর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিগত সরকারের বিদায় হয়েছে। তারা পুলিশকে নিজেদের মতো করে অপব্যবহার করেছিল। যার কারণে পুলিশ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়। সে পরিস্থিতি থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুলিশ কাজে ফিরতে শুরু করে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তারা নানাভাবে চেষ্টা করছে। তবে আমি মনে করি তাদের আরো মনোযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে যেন কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা অপরাধ সংঘটিত না হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেন না ঘটে। পুলিশের মনোবল শতভাগ বৃদ্ধি করা না গেলে তার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবাও পাওয়া যাবে না। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বাণিজ্যিক হাবগুলোয় দ্রুত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ বাহিনীকে গ্রহণ করতে হবে।’
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ধানমন্ডির দিকে যেতে হাতের ডানে মোহাম্মদপুর থানা। বসিলা, চাঁদ উদ্যানসহ মোহাম্মদপুরে বেশ কয়েকটি ক্রাইম জোন এ থানাটির অধীনে। মোহাম্মদপুর থানার কার্যক্রম শুরু হলেও কার্যত তা এখনো কাগজে-কলমে হাজিরা দেয়ার মধ্যেই সীমিত। পুলিশের টহল বা তল্লাশি চৌকি পরিচালনা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। একই পরিস্থিতি আদাবর, মাজার রোড, মিরপুর ও পল্লবী থানার। এ থানা এলাকাগুলোও মাদক ও অস্ত্রকেন্দ্রিক ক্রাইম জোন। এসব এলাকায়ও পুলিশের টহল কার্যক্রম এখনো দৃশ্যমান হয়নি। দেখা যায় না নিয়মিত তল্লাশি কার্যক্রমও। ফলে এসব এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুনের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার প্রবেশমুখ গাবতলীকেও এখনো নিরাপদ করে তোলা যায়নি। যার ফলে গাবতলীর রাস্তা ব্যবহার করে ঢাকায় প্রবেশ করা পণ্যবাহী গাড়িগুলো থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মূলত এখন কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না। কেবল নির্ধারিত সময় ধরে থানায় ডিউটি করাই এখন তাদের প্রধান কাজ। দৈনিক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করা এবং থানার ভেতরে টেবিলওয়ার্কের দিকেই তাদের বেশি মনোযোগ। বাইরে ডিউটি করতে গেলে নানা ধরনের অপরাধের শিকার হয়ে ভুক্তভোগীরা তাদের কাছে আসেন। কিন্তু তাদের জন্য তেমন কিছুই করার থাকে না। ছিনতাইকারীকে ধরতে গেলেও হামলার শিকার হতে হয় তাদের। এমন পরিস্থিতিতে নিয়মিত টহল এবং তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক উপপুলিশ পরিদর্শক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘চোর ধরে আনলেও সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাইরে ডিউটি করে ভুক্তভোগীদের সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সে জন্য থানায় বলে টেবিলওয়ার্কগুলো নিয়মিত সম্পন্ন করছি।’
ভাসমান অপরাধী ও পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রেক্ষাপটে নগরবাসীকে পুলিশি সেবা প্রদানে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে পুলিশ। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অপরাধ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে ডিএমপি। ভাসমান অপরাধী ও পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রেক্ষাপটে নগরবাসীকে পুলিশি সেবা প্রদানে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
তবে পুলিশ বলছে, স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর পর জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাহিনীর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আমরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল অতি দ্রুত পুলিশের ইউনিটগুলোকে অপারেশনাল করা এবং জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেয়া। পুলিশ সদস্যরা পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ইউনিটগুলোকে দ্রুতই অপারেশনাল করেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদস্যদের সাহস ও মনোবল অটুট রেখে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের লক্ষ্য আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এলাকা ভেদে অপরাধের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। সে অনুযায়ী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’