Image description

৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে অস্বস্তি দেখা দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় সাত মাস পার করলেও দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে টানাপড়েন থামছে না। তবে সম্প্রতি ওমানের রাজধানী মাস্কাটে ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের ফাঁকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠক নতুন বার্তা দিচ্ছে।

তৌহিদ-জয়শঙ্করের বৈঠকের পর দিল্লি থেকে সুখবর এসেছে ঢাকায়। চৌকস কূটনীতিক রিয়াজ হামিদুল্লাহ’র এগ্রিমো (নিয়োগের প্রস্তাব) গ্রহণ করেছে দিল্লি। রিয়াজ এখন দিল্লিতে বাংলাদেশের নতুন হাইকমিশনার। তিনি সাবেক হাইকমিশনার মোস্তাফিজুর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হবেন।

নির্ভরযোগ্য কয়েকটি কূটনৈতিক সূত্র ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্রের বরাতে জানা গেছে, ড. ইউনূস সরকারের প্রস্তাবিত দূতের এগ্রিমো গ্রহণ করেছে দিল্লি। দিল্লির সবুজ সংকেত মেলায় এখন আর দূত পাঠাতে কোনো বাধা রইল না ঢাকার।

স্থানীয় কূটনীতিকরা বলছেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তন এবং ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে অস্বস্তি কাটানোর পাশাপাশি নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির চ্যালেঞ্জ নিতে হবে নতুন দূতকে। সামনের দিনগুলোতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটি নতুন দূতের পারফরম্যান্সের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করবে। প্রত্যাশার কথা হচ্ছে, বহুপাক্ষিক অর্থনীতি ও কানেক্টিভিটিতে ভালো দখল থাকা রিয়াজ আগে থেকে ভারতকে চেনেন-জানেন। তিনি ভারতে পড়াশোনার পাশাপাশি কূটনীতিক হিসেবে কাজও করেছেন।

বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মিশনের একটি দিল্লি। গত বছরের নভেম্বরে (২০২৪) পেশাদার কূটনীতিক রিয়াজ হামিদুল্লাহ’র জন্য ভারত সরকারে কাছে এগ্রিমো পাঠায় বাংলাদেশ সরকার। তখন রিয়াজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আঞ্চলিক সংস্থা ও বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক বিষয়াবলি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। ছিলেন অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব। পরে পূর্ণাঙ্গ পররাষ্ট্রসচিব হয়েছেন রিয়াজ। তিনি বর্তমানে পররাষ্ট্রসচিব (পশ্চিম) হিসেবে সদর দপ্তর ঢাকায় কর্মরত আছেন।

সম্পর্কের টানাপড়েন বিবেচনায় গত বছরের নভেম্বরে দিল্লিতে পাঠানো এগ্রিমো আসতে দেরি হওয়া এক ধরনের ‘শঙ্কা’ তৈরি করে। প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হলেও কেন দিল্লি থেকে এগ্রিমো আসছে না– এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাদের বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বরাবরই বলে এসেছেন, আমরা এগ্রিমো পাঠিয়েছি এবং ভারত থেকে এটার উত্তরের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি। সাধারণত এগুলোর নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। তবে দুই থেকে চার মাসের মধ্যে চূড়ান্ত হয়ে যায়।

রিয়াজ হামিদুল্লাহ’র চাকরির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৯ সালের সেপ্টেম্বরে। রাষ্ট্রদূত রিয়াজ নেদারল্যান্ডস ও শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

রিয়াজ হামিদুল্লাহ দিল্লি ও নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি নেপালের কাঠমান্ডুতে সার্ক সচিবালয়ে বাংলাদেশের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রিয়াজ দিল্লির বাংলাদেশ হাকমিশনে কাজ করেছেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক বিষয়াদি, দক্ষিণ ও ইউরোপিয়ান অ্যাফেয়ার্স ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ে কাজ করেছেন।

শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে ১৫তম ব্যাচের মেধা তালিকায় প্রথম পেশাদার এ কূটনীতিককে নেদারল্যান্ডস থেকে ঢাকায় ফেরানো হয়। তিনি তখন নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছিলেন। রিয়াজ ঢাকায় ফেরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের উত্তরসূরি হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।

তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্বের পুরোটা সময় শেষ করার আগেই বিদায় নিতে হয়। আর চীনে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জসীম উদ্দিনকে মাসুদ বিন মোমেনের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। তিনি বর্তমানে পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।

কূটনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকা-দিল্লির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অস্বস্তি দেখা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে ভারতের সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এবং কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার ঘটনা আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিবেশ তৈরি করে।

তবে গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরের পর দুই দেশের সম্পর্ক অনেকটাই শীতল হয়। তার এ সফরের পর গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ভারতীয় জেলে ও ভারত বাংলাদেশি জেলেদের মুক্তি দিয়ে নিজ দেশে ফেরত পাঠায়। ওই সময় ১৮৫ জন মুক্তি পান। এ ছাড়া দুই দেশই জেলেদের আটক করা নৌযানও ফেরত দেয়।

তবে এ ‘শীতল সম্পর্ক’ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণসহ সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আবার দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। সেসময় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে বাংলাদেশ। এর ২৪ ঘণ্টা না যেতেই ভারতও নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার নুরাল ইসলামকে তলব করে। সেগুলোর রেশ কাটতে না কাটতেই আসে শেখ হাসিনার বক্তব্য ইস্যু।

হাসিনার বক্তব্যের কারণে দেশে নতুন করে আবারও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে— এমনটি জানিয়ে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। এরপর বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে‌ দিল্লি।

এতেই থেমে থাকেনি ভারত। তারা ঢাকার ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়। কিন্তু নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের এমন প্রতিক্রিয়া ভালোভাবে নেয়নি ঢাকা।

চলমান এমন টানাপড়েনের মধ্যে গত রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) মাস্কাটে তৌহিদ-জয়শঙ্করের বৈঠকের পর বরফ গলতে শুরু করেছে নাকি ঢাকায় পরবর্তী দূত নিয়োগের বিষয়টি মাথায় রেখে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

প্রসঙ্গত, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার উত্তরসূরির কথা ভাবছে দিল্লি। কেননা, প্রণয়ের চলে যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে গেছে।