Image description
 

শেখ হাসিনার আইনেই তার বিচার দেখতে চায় বিএনপি। এ জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে শেখ হাসিনাকে যুক্ত করার বিধান বহাল রাখতে সংবিধান সংস্কার কমিশনে সুপারিশ করেছে জাতীয়তাবাদী দলটি। পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্তরা ভোটার হতে পারবে না বলে যে বিধান শেখ হাসিনা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, সেটাও পরিবর্তন না করার কথা বলেছেন তারা।

কমিশনে দেওয়া প্রস্তাবে বিএনপি বলেছে, জুলাই গণহত্যার বিচারের জন্য এ বিধান বহাল রাখতে হবে। অবশ্য সংবিধান সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সুপারিশ করেনি। তাদের অভিমত, কোনো বিষয়ে সুপারিশ না করার অর্থ হচ্ছে তারা বিদ্যমান বিধানকে যৌক্তিক মনে করেছে।

শেখ হাসিনার প্রণীত বিধানগুলো বিএনপি সংবিধানে বহাল রাখার কথা বললেও ‘যে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচারের টার্গেট করে’ সংবিধানে ওই বিধানগুলো যুক্ত করা হয়, সেই জামায়াতে ইসলামী তার প্রস্তাবে এগুলো বাতিলের সুপারিশ করেছে। অবশ্য দলটির সুপারিশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্তদের মৌলিক অধিকার না রাখার কথা বলা হয়েছে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই দিনই কমিশনের সুপারিশের সারসংক্ষেপ ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। পরে ৮ ফেব্রুয়ারি সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি কমিশন তাদের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংবিধান সংস্কার কমিশন পাঁচ খণ্ডে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিএনপি গত বছরের ২৫ নভেম্বর সংস্কার কমিশনের কাছে ১১ পৃষ্ঠার লিখিত প্রস্তাবনা দেয়।

সংবিধান সংস্কার কমিশন তার সুপারিশ প্রণয়নে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় না করলেও দলগুলোকে চিঠি দিয়ে লিখিত মতামত নিয়েছে। দলগুলো যেসব মতামত দিয়েছে তা সুপারিশের পঞ্চম খণ্ডে হুবহু তুলে ধরেছে। পাশাপাশি তৃতীয় খণ্ডে দলগুলোর সুপারিশের তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের সারাংশে কমিশন বলেছে, কমিশন মোট ২৭টি রাজনৈতিক দল ও তিনটি জোটের কাছে লিখিত মতামত চেয়ে চিঠি দেয়। ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল এবং তিনটি জোট লিখিত মতামত দেয়। যেসব রাজনৈতিক দল ও জোট জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় সক্রিয়ভাবে হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থেকেছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নকে সমর্থন করেছে, ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছে, কমিশন সেসব দল ও জোটকে সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশ তৈরিতে যুক্ত করেনি।

বিএনপি তার সুপারিশে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন এনে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে যে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছিল, তার কিছু কিছু বাতিলের সুপারিশ করেছে। অপরদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-সংক্রান্ত সংবিধানের ৪৭(৩), সংসদ সদস্যদের যোগ্যতাবিষয়ক ৬৬ এবং ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি-সংক্রান্ত ১২২ অনুচ্ছেদসহ পঞ্চদশ সংশোধনীর বেশকিছু সংশোধন বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। দলটি জুলাই গণহত্যা ২০২৪-এর বিচারের স্বার্থে এ প্রস্তাব দিয়েছে বলে কমিশনকে জানিয়েছে।

শেখ মুজিবের শাসনামলে গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধে সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্যদের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে ৪৭(৩) বিধান যুক্ত করা হয়। এই বিধানের অধীন বেসামরিক ব্যক্তি ও সংগঠনকে বিচারের আওতায় আনতে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। এ ছাড়া ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন কোনো অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তি দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে নতুন বিধান যুক্ত করেন শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দণ্ডিত ব্যক্তি ভোটার হতে পারবেন না বলেও আরেকটি বিধান তিনি যুক্ত করেন।

সংবিধান সংস্কার কমিশনে দেওয়া প্রস্তাবনায় বিএনপি এই তিনটি বিধানই বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। এ বিষয়ে প্রস্তাবে দলটি বলেছে- ‘জুলাই গণহত্যা ২০২৪-এর বিচারের স্বার্থে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনীত পরিবর্তন বহাল রাখতে হবে।’

এর বাইরে বিসমিল্লাহ; রাষ্ট্রধর্ম (২ক); উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি (২৩ক); মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ (৪৪), সংসদ সদস্যদের পারিশ্রমিক (৬৮); নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা (১২৩) ও বিচার বিভাগসংক্রান্ত বেশকিছু বিধান (৯৪-১১২) বিষয়ে ২০১১ সালের সংশোধনী বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে দলটি।

অপরদিকে ‘জাতির পিতার’ প্রতিকৃতি (৪ক); নাগরিকত্ব (৬); সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ (৭ক); সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য (৭খ); মূলনীতি (৮); জাতীয়তাবাদ (৯); সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি (১০); ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা (১২); ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি (১৫০); তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিলসহ বেশকিছু বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছে।

অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী সুপারিশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারসম্পর্কিত বিদ্যমান সংবিধানের ৪৭(৩), ৪৭ক ধারা বাতিল করতে বলেছে। দলটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে- এই ধারা দুটি প্রক্রিয়াগত অপব্যবহারে পরিণত হয়েছে। ধারাগুলো প্রিসাম্পশন অব ইনোসেন্স ধারণার বিপরীত। এই ধারা দুটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। কারণ, এই বিধান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) অপব্যবহৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে আইসিটি আইনটি সংশোধন করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি ভোটার হতে পারবেন না বলে আওয়ামী লীগ সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদে যে বিধানটি যুক্ত করেছে, জামায়াত সেটাও বাতিল করার সুপারিশ করেছে।

দলটি বলেছে- আজকের দিনে এ ধারাটির কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, যেমনÑ বিশেষ কিছু ব্যক্তিকে অভিযোগে অভিযুক্ত থেকে বঞ্চিত করা গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বিশেষ করে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার নীতির সঙ্গে। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি ভিত্তি, যা নিশ্চিত করে যে, সব নাগরিকের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ রয়েছে। এমনকি যারা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্তÑ যেমন রাষ্ট্রদ্রোহের মুখোমুখি, তাদেরও বাদ দেওয়া অন্যায় এবং অসমতা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। গণতন্ত্র ইনক্লুসিভিটির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে এবং সব নাগরিককে ভোট দেওয়ার অধিকার দেয়, সমাজ গঠনে সবাই যে অংশীদার তা নিশ্চিত করে। এ ছাড়া যেসব ব্যক্তিকে সহযোগীদের আদেশে দণ্ডিত করা হয়েছে, তারা আর জীবিত নেই।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা যেসব বিষয়ে সুপারিশ করিনি, ধরে নিতে পারেন আমরা ওইগুলোর সঙ্গে একমত।’

অপর সদস্য ড. শরিফ ভূঁইয়াও একই ধরনের মন্তব্য করেন। আমার দেশকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘যেসব বিষয় আমরা মনে করেছি বাতিল, সংশোধন বা যুক্ত করার দরকার, আমরা সেসব বিষয়ে সুপারিশ করেছি। যেসব বিষয়ে আমাদের সুপারিশ আসেনি, ধরে নিতে হবে বিদ্যমান বিধানের প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে।’

জামায়াত সংবিধানের প্রস্তাবনায় জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি থাকতে হবে বলে কমিশনের কাছে প্রস্তাব করেছে।

বিএনপি দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বলে প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে সংবিধান কমিশন কোনো ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বলে সুপারিশ করেছে। বিএনপি (৭০ অনুচ্ছেদ) আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রশ্ন বাদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিল। কমিশন কেবল অর্থবিল ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছে।