Image description
এসডিজি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে

রাশেদ রাব্বি 8 দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে প্রণয়ন করা হয় স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি (এইচএনপিএসপি) অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপি, যা বহুজাতিক ঋণদাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত হতো। ২৭ বছর ধরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো ও সেবা নিশ্চিতে পরিচালিত এই কার্যক্রম বন্ধ হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ওপি বাতিল করে দুই বছরের প্রকল্প প্রণয়ন করতে অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, স্বল্পতম সময়ে এমন প্রকল্প প্রণয়ন অসম্ভব। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পঞ্চম এইচএনপিএসপির অধীনে ৩৮টি ওপির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করেছিল। ১৯৯৮ সালে চালু হওয়া খাতভিত্তিক পদ্ধতি অনুসারে এটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল।

এ পরিকল্পনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, রোগ নিয়ন্ত্রণ, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, মাতৃ ও শিশুর যত্ন, চিকিৎসা শিক্ষা, টিকাদান কর্মসূচি, পরিবার পরিকল্পনা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের মতো বিস্তৃত সেবা অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ওপি অনুমোদন হয়নি। অন্যদিকে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে ওপি অনুমোদন না করে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ৯ মাস ধরে স্বাস্থ্য খাতের স্বাভাবিক কার্যক্রম অনেকটা স্থবির অবস্থায় রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরপ্রধানদের গত ৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শিরিন আখতার এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠান। সেখানে বলা হয়, ‘জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ওপির অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ ওপি পিআইপির ভলিউম-১ (ওপি সামারি) এবং ভলিউম-২ (সব ওপির জন্য) ও ভলিউম-৩ (পিএফডি ওপির জন্য) সংশ্লিষ্ট অংশ পুনর্গঠন করে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সফট কপিসহ হার্ড কপি পাঠাতে অনুরোধ করা হলো।’ এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ওপিগুলো জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মসূচির অগ্রগতি অর্জন করেছে। যেমন ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, জলাতঙ্ক—এসব রোগের কোনোটি নির্মূল হয়েছে, কোনোটি নির্মূলের পথে।

তবে এজন্য সময় প্রয়োজন। যেমন—কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচি শুরু করা হয় ২০০৫ সালে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি মিলেছে ২০২৩ সালে। অর্থাৎ দেশ থেকে এই ভয়বহ রোগটি নির্মূলে সময় লেগেছে প্রায় ১৮ বছর, যা সম্ভব হয়েছে ওপির ধারাবাহিকতার কারণে।’ তিনি বলেন, ‘এক বা দুই বছরের প্রকল্পের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য কাজ করা সম্ভব নয়। সেটি ইতোপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। যার ফলে কার্যকর উন্নতি সাধনে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে অনেক সময় আমলাতান্ত্রিক কারণে ওপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন—বিগত ওপিতে শেষের দুই বা এক বছরে নো কস্ট এক্সটাকশন নীতি গ্রহণের পর কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থ স্বল্পতায় দুই বছর ধরে কুকুরের ভ্যাকসিন কেনা হচ্ছে না। এতে দেশে জলাতঙ্ক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।’ অধ্যাপক বে-নজির আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনার পরিবর্তে দুই বছর মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি যথাযথ নয়। এ ক্ষেত্রে এরই মধ্যে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। যেমন—দুই বছরের প্রকল্প, যেখানে আট মাস এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরিতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই স্বল্পতম সময়ে এটা করা অসম্ভব। পাঁচ বছরের কাজ দুই বছরে আনলে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি ঝুঁকিতে পড়বে, হাসপাতালে রোগী বাড়বে, সেবা কমবে, মানুষের দরিদ্রতা বাড়বে।

সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটবে।’ পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের একজন প্রাক্তন লাইন ডিরেক্টর বলেন, ভূতপূর্ব সময় ধরে প্রকল্প প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। সেই হিসাবে দুই বছরের আট মাস এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। বাকি ১৬ মাসের জন্য কোনো লোকবল পাওয়া যাবে না। এই স্বল্প সময়ে সেবা কেনা বা পণ্য কেনাও অর্থপূর্ণ হবে না। পণ্য, বিশেষ করে চিকিৎসা যন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে সময় গুরুত্বপূর্ণ। দামি যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে তিন, পাঁচ বা সাত বছরের বিক্রয়োত্তর সেবা নেওয়া হয়। যন্ত্র দুই বা এক বছরের জন্য কেনা হলে এই সুবিধা থাকবে না। এমনকি সুবিধা থাকলেও সেটি ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে কোনো লোকবল থাকবে না। অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মসূচি ব্যবস্থাপকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হলে তারা বলেন, লাইন ডিরেক্টররা নতুন এসেছেন। তাদের অনেকেই ওপি বোঝেন না। তারা মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়ে আমাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলেছেন। কিন্তু এই স্বল্পতম সময়ে ভূতাপেক্ষ আট মাসসহ দুই বছরের জন্য যৌক্তিক ও কার্যকর প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমনকি আমরা অভিজ্ঞ পরিচালকদের পরামর্শ নিয়েছি। তারা বলেছেন, ওপির প্রথম দুই বছরের কার্যক্রম পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু এতে কারোই লাভ হবে না। দেশের অর্থ অপচয় হবে এবং কিছু অসাধু ব্যক্তির পকেট ভরবে।

সামগ্রিক বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, স্থায়ী ও শক্তিশালী স্বাস্থ্য খাতের লক্ষ্যে বিস্তর গবেষণার পর আমরা অপারেশনাল প্ল্যান প্রণয়ন করি, যা ১৯৯৮ সাল থেকে কার্যকর হয়। একটা সময় স্বাস্থ্য খাতে শতাধিক প্রকল্প ছিল। প্রকল্প বাস্তবায়ন হতো, কিন্তু স্বাস্থ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি ছিল না। তখন ভিটামিনের অভাবে শিশুরা রাতকানায় ভুগত, নানা সংক্রামোক রোগে ভুগে মারা যেত। দেশের জন্মহার ও মৃত্যু ছিল অনেক বেশি। ওপির মাধ্যমে শতাধিক প্রকল্প কমিয়ে ২৩টিতে আনা হয়। আমাদের গবেষণাপ্রসূত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য খাত ধীরে ধীরে বিভিন্ন সংক্রামোক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, শিশুদের রোগ টিকাদান ও ভিটামিনের অভাব পূরণ, এমনকি দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সরকারের ওপি বাতিলের সিদ্ধান্তে দেশের স্বাস্থ্য খাত মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালের আগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতোই বিষয়ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হতো। তাতে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো ১২৬টি প্রকল্প একীভূত করে ১৯৯৮-২০০৩ সাল (৫ বছর) মেয়াদে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি (এইচপিএসপি) শীর্ষক প্রথম সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাতিল হতে যাওয়া পঞ্চম এইচএনপিএসপিতে ৩৮টি ওপি রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ২৩টি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ১৫টি। এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বাড়ানো, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।