Image description

ছিলেন কুষ্টিয়ার এলাকাভিত্তিক ছোট ঠিকাদার। ২০০১ সালে বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলে স্থানীয় এক সংসদ সদস্যের ছোঁয়ায় রাতারাতি বদলে যায় ভাগ্য। জেলার বড় বড় কাজ পেতে থাকেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভোল পাল্টে মিশে যান দলটির সঙ্গে। হয়ে ওঠেন জেলার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ঠিকাদার। এর ধারাবাহিকতায় কুষ্টিয়া অঞ্চলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার সহায়তায় পা রাখেন ঢাকায়। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) নিজের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। গত ১৫ বছরে পাউবোসহ অন্তত ছয়টি সেক্টরে নিজের প্রভাব খাটিয়ে ও কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাগিয়েছেন। এর বাইরে যেসব কাজ রয়েছে, তা-ও কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে বণ্টন করেছেন নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের মধ্যে। অনেকের কাছে ‘ম্যানেজ মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত আলোচিত এই ঠিকাদারের নাম বশির আহমেদ। তিনি ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যতগুলো কাজ তিনি করেছেন, তার ৬০ ভাগ কাজেই এসেছে অনিয়মের অভিযোগ। এ ছাড়া প্রায় ৬০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এই ঠিকাদার কোনো কাজই সঠিক সময়ে শেষ করতে পারেননি, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০০৯ সাল-পরবর্তী সময় থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং দেড় শতাধিক ঠিকাদারি কাজ করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ কাজই ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগেই হয়েছে লুটপাট। এখনো ৫২টি কাজ চলমান রয়েছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের।

জানা যায়, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে বিভিন্ন কাজে প্রভাব বিস্তার করতেন বশির। বাগেরহাটের মোংলা বন্দর এলাকায় যৌথ মালিকানায় জমিও কিনেছেন। হানিফের মালিকানাধীন কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনালের ড্রেজার এখন ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হেফাজতে। বশির দেখভাল করছেন হানিফের সম্পদও। প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজও করেছেন। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ইকোনমিক জোন, রাজউক, সড়ক ও জনপথ, এলজিইডিসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজও বাগিয়েছেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, বশির আহমেদের প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং শুধু কাজ নেওয়ার ক্ষেত্রেই অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে এমন নয়, কাজ সম্পন্ন করতেও অনিয়ম-লুটপাট করেছে। তথ্য বলছে, খুলনার টাউন খালিশপুরে অবস্থিত খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে পুরোনো যন্ত্রাংশ কেনার ক্ষেত্রে ‘পুকুর চুরি’ করেছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। সরকারি কর্মকর্তা ও মিল-সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি দামের যন্ত্রাংশ মাত্র ৬৮ কোটি টাকায় কেনে বশিরের প্রতিষ্ঠান। মিলের যন্ত্রাংশ কেনার জন্য ১৭টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দিলেও শুধু বশিরের প্রতিষ্ঠানের দরপত্র খুলে তাদেরই কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে মাতব্বরহাট এলাকা মেঘনা নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ঘেঁষেই ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্লক নির্মাণের কারখানা। নদীর অন্যান্য এলাকায় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে প্রতিষ্ঠানটি পাঁচটি প্যাকেজের ১৫টি লটে কাজ করছে। সেসব স্থানে ব্লক নিতে নদীপথ ব্যবহারের জন্য তীর রক্ষা বাঁধটি কেটে ট্রাক্টর চলাচলের রাস্তা করা হয়েছে। এ ছাড়া বাঁধের ব্লক সরিয়ে দুটি অস্থায়ী জেটি স্থাপন করা হয়েছে। এতে মাটি সরে বাঁধটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে এবং যে কোনো সময় বাঁধ ধসে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নে ২০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করা হয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজরিত রবীন্দ্র কুঠিবাড়ী রক্ষা করা। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কিছুদিনের মধ্যেই বাঁধের কয়েকশ মিটার জায়গা ধসে পড়ে। আরও কয়েকটি স্থানেও দেখা দেয় ভাঙন। স্থানীয় জনপ্রিতনিধিরা তখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কাজে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিলেন। পরে প্রতিষ্ঠানটিকে দুই কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়।

এর আগে ২০১৫ সালে উদ্বোধন করা হয় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কুর্নিবাড়ী-কুতুবপুর-রহদহ-কামালপুর এলাকায় যমুনা নদীর ডান তীরে বিআরই বিকল্প বাঁধ নির্মাণ কাজ, অন্তরপাড়া, দড়িপাড়া এবং পাশের এলাকায় যমুনা নদীর ডান তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংরক্ষণ প্রকল্প। তবে এসব প্রকল্পের কাজ শেষে উদ্বোধনের কিছুদিন পরেই ভেঙে যায় বাঁধ। স্থানীয়রা বলছেন, প্রতি বছরই এই বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। পরে পাউবো ফের সংস্কার করে।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনার তীরে এক কিলোমিটার দীর্ঘ যে বাঁধ পাউবো নির্মাণ করেছে, সেটাও করেছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই বাঁধের ১০০ মিটার চলে যায় নদীতে। এতে বাকি কাজ নিয়েও দেখা দেয় শঙ্কা। পরে অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে পুনরায় ব্লক ফেলে মেরামত করে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

শুধু এসব কাজই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভিন্ন স্থানে যত কাজ করেছে, তার বেশিরভাগ কাজে নিয়েই ছিল অনিয়মের অভিযোগ। অনেক কাজেই যেমন শেষ করার পরপরই বিভিন্ন সমস্যা বেরিয়ে এসেছে, তেমনি কিছু কাজের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ নিয়ে দায়সারা কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। ঝালকাঠির সুগন্ধা, গাবখান ও ধানসিঁড়ি নদীর মোহনায় নৌ চলাচলের চ্যানেলের প্রস্থ বাড়ানো এবং চর অপসারণের কাজ পেয়েছিল ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। কাজ শেষ হলেও অবস্থা আগের মতোই। এখনো সেই চ্যানেলে একমুখী চলাচল রয়েছে। আছে চরও। তবে কাজবাবদ পাওনা পুরোটাই তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

এ ছাড়াও কক্সবাজারের চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর ওপর ৩২ কোটি টাকার রাবার ড্যাম প্রকল্প, মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ইউনিয়নের রাজঘাট এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ, গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলার চারটি পয়েন্টে যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার কালিয়াকৈর-বাঁশতলী আঞ্চলিক সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ, মেহেরপুরের ভৈরব নদী পুনর্খনন, তজমুদ্দীন উপজেলায় নদীরক্ষা বাঁধ, শরীয়তপুরের সুরেশ্বর দরবার শরিফে পদ্মা নদীর ডান তীরে প্রতিরক্ষামূলক কাজ, রাজশাহী শহরের পদ্মা নদীর বাম তীর বরাবর নদীতীর রক্ষার কাজসহ প্রায় ৬০ ভাগ কাজ নিয়েই পাওয়া গেছে অনিয়মের অভিযোগ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, পাউবোতে যতগুলো বড় প্রকল্প হয়েছে প্রায় সবগুলোতে ঠিকাদারি কাজ নিয়েছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। কেবল কাজ নেওয়াই নয়, বাকি কাজ বণ্টনের দায়িত্বও পালন করতেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদ। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ প্রতিষ্ঠানটির পার্টনার—এমন তথ্য দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন সর্বত্র। এ ছাড়া যখন যিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব হয়েছেন, সবার সঙ্গেই গড়ে তুলতেন সম্পর্ক। বিশেষ করে সাবেক পানি সচিব কবির বিন আনোয়ারের সময়কালে বিভিন্ন কাজ বাগাতেন লভ্যাংশ বণ্টনের বিনিময়ে। এ ছাড়া পাউবোর মহাপরিচালক, প্রধান প্রকৌশলীদের সঙ্গেও সদ্ভাব ছিল বশির আহমেদের।

ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, ঠিকাদারির টাকায় বশির আহমেদ গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে টাইগার সিমেন্ট, টাইগার কনক্রিট প্রোডাক্টস, ভিনসেন কনসালট্যান্সি, ওয়েস্টার্ন রিনিউয়েবেল এনার্জি, ওয়েস্টার্ন সুপিরিয়র জুট ইন্ডাস্ট্রি, ওয়েস্টার্ন ডায়গনস্টিক অ্যান্ড হেলথ কেয়ার, ওয়েস্টার্ন ওভারসিজ, ইমপারো প্রোপার্টিজ, ওয়েস্টার্ন ড্রেজটেক। এ ছাড়া পতিত আওয়ামী লীগ নেতা এইচ বি এম ইকবালের সঙ্গে যৌথভাবে গড়ে তুলেছেন আইবিসি পাওয়ার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন করে ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দেন বশির। বিএনপিমনা ব্যবসায়ী, নেতা এবং কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। জানা যায়, এরই মধ্যে বাংলাদেশ কাটার সাকশন ড্রেজার অ্যাসেসিয়েশনের নতুন কমিটির সভাপতি হয়েছেন বশির আহমেদ। এর আগে তিনি ছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি। অভিযোগ রয়েছে, নতুন কমিটিতে তিনি বিগত সরকারের সুবিধাভোগীদেরই জায়গা করে দিয়েছেন। এর মধ্যে এক নম্বর সহসভাপতি করা হয়েছে রকিবুল আলম দীপুকে, যিনি সাবেক নৌমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত।

বশির আহমেদের অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বশিরের বিরুদ্ধে ৫১ কোটি ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৩ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদের সঙ্গে। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর বশির আহমেদের বিশেষ সহকারী রিয়াদ হোসেনকে ফোন করলে তিনি কথা বলিয়ে দেবেন বলে জানান। তবে কিছুক্ষণ পরেই ওয়েস্টার্ন গ্রুপের ডিজিএম (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) পরিচয় দিয়ে মেহেদী হাসান নামে একজন যোগাযোগ করেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সব অস্বীকার করে কালবেলাকে বলেন, ‘ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সব কাজ সব ধরনের নিয়ম মেনেই হয়। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোথাও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কাজ করে না।’

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. এনায়েত উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে বিষয়ে বললেন, সেটি সম্পর্কে আমার জানা নেই, খোঁজখবর নিতে হবে। তবে কোনো কাজে অভিযোগ এলে কিংবা অভিযোগ ছাড়াও কোনো পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও আমরা তদন্ত করি। তদন্ত করে কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’