
নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় বিপর্যস্ত গাজীপুর সাফারি পার্ক। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পার্কটি দুর্নীতির অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরও লুটপাট থামেনি। বর্তমানে নবীন ও প্রবীণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির কারণে পার্কটি ধ্বংসের পথে। পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে এই অনিয়ম চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পার্ক শুরুতে দেশি-বিদেশি বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও দর্শনার্থীদের বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। তবে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে পার্কটির জনপ্রিয়তা ও কার্যকারিতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি অর্থবছরে সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও অনিয়মের কারণে এই পার্ক এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাণীর মৃত্যু ও অব্যবস্থাপনা: অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে একের পর এক প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর পার্কে একটি সিংহ ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট মারা যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহের মৃত্যু ঘটে। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর পার্কে মারা যায় একটি জিরাফ, যার ফলে পুরুষ জিরাফের অভাবে প্রজনন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ২০২১ সালে পার্কে তিনটি ক্যাঙারু মারা যাওয়ার পর থেকে ক্যাঙারুশূন্য হয়ে যায়।
এ ছাড়া, পার্কের লেকগুলো একসময় ব্ল্যাক ও হোয়াইট সোয়ানে পরিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে একটিও নেই। প্রাণীর মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
গাছ পাচার ও বন উজাড়: স্থানীয় বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিল জানান, সন্ধ্যার পর পার্ক থেকে পিকআপভর্তি গাছ পাচার হয়। কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ও তার কিছু সহযোগী এই গাছ পাচারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতাকর্মীদের সহায়তায় এসব গাছ বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভাওয়ালের শালবনের ৩ হাজার ৮১০ একর ভূমি পার্কের অন্তর্ভুক্ত ছিল। একসময় এখানে ঘন বৃক্ষরাজি থাকলেও কর্তৃপক্ষের গাছ পাচারের ফলে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
রাজস্ব ফাঁকি ও ইজারা দুর্নীতি: পার্ক প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইজারার মাধ্যমে পরিচালনার কথা থাকলেও বন বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সিন্ডিকেটের কারণে পার্কে কোটি কোটি টাকা ইজারার বকেয়া রয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ইজারাদারদের সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রতি বছর পার্কের মূল ফটক ও কোর সাফারি ইজারায় ৫ কোটি টাকা পাওয়ার সক্ষমতা থাকলেও করোনা পরবর্তী সময়ে বন বিভাগ রহস্যজনকভাবে ইজারা না দিয়ে নিজেরা পরিচালনার নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে।
বর্তমানে পার্ক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ইজারাদারের কাছে প্রায় ৮ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা থাকলেও, তা আদায়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু জেলা প্রশাসকের রাজস্ব আদালতে মামলা করে দায় সারছে।
প্রাণীর খাদ্যে অনিয়ম: সাফারি পার্কে প্রাণীদের খাবার সরবরাহ নিয়েও বিস্তর অনিয়ম চলছে। বিভিন্ন সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খাদ্য সরবরাহে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করেছে। অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে তাদের এই সুযোগ করে দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। সঠিক খাবারের অভাবে অনেক প্রাণীই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর সাফারি পার্কের সহকারী বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আমার কোনো আত্মীয় নেই, এলাকার কিছু গরিব ছেলেপেলেকে কাজ দিয়েছি।’ গাছ পাচারের বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ‘এটা ঠিক নয়, মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কারণে হয়তো কিছু বের হয়।’ অন্য সব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বক্তব্যের জন্য পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, তিনি বিদেশ সফরে রয়েছেন। একই বিভাগের বন কর্মকর্তা শারমিন আক্তারও বর্তমানে ওমরাহ পালনে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। অন্য কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।