Image description
 

সিরামিক খাতের তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি আরএকে সিরামিকস (বাংলাদেশ) লিমিটেড। ২০২৪ হিসাব বছরে কোম্পানিটি করপূর্ব মুনাফা করেছিল ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

 

সিরামিক খাতের তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি আরএকে সিরামিকস (বাংলাদেশ) লিমিটেড। ২০২৪ হিসাব বছরে কোম্পানিটি করপূর্ব মুনাফা করেছিল ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। যদিও এ সময়ে কোম্পানিটিকে মোট কর পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অ‌গ্রিম আয়করকে ন্যূনতম কর হিসেবে ধার্য করায় বছর শেষে কোম্পা‌নি‌টি অর্থ ফেরত পায়‌নি। এর ফলে ২০২৪ হিসাব বছরে আরএকে সিরা‌মিকসকে করপরবর্তী নিট লোকসান গুনতে হয়েছে ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিসহ দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেই এখন এমন বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এ বিড়ম্বনার পেছনে অগ্রিম আয়কর বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। মূলত রাজস্ব আহরণের সহজ পদ্ধতি হিসেবে দেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অগ্রিম কর বা আয়কর আরোপ করা হয়। এছাড়া এটি কর ফাঁকি প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচিত। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে উৎসে কর হিসেবে বা ব্যবসার টার্নওভারের ওপর এ ধরনের কর ধার্য করা হয়।

যদিও এ কর নিয়ে এখন নানা ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ উদ্যোক্তাদের। তারা বলছেন, ব্যবসায় মুনাফা হওয়ার আগেই অগ্রিম আয়কর কেটে নেয় রাজস্ব কর্তৃপক্ষ। বছর শেষে মুনাফা কম হলে অগ্রিম কেটে নেয়া আয়কর সমন্বয় হওয়ার কথা। কিন্তু সে সমন্বয় প্রক্রিয়ায় নানা দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা রয়েছে। এ নিয়ে শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তাদের দাবি, বিরাজমান সংস্কারের ধারাবাহিকতায় রাজস্ব আহরণের এ পদ্ধতিটিরও সংস্কার করা হোক।

 

খাতসংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, অগ্রিম কর পরিশোধের উদ্যোগ রাজস্ব ফাঁকি রোধ করতে না পারলেও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসার জন্য বিপত্তির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বছর শেষে দেখা যায়, ব্যবসার মুনাফার চেয়ে পরিশোধিত করের পরিমাণ বেশি। এ ধরনের পরিস্থিতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর ফাঁকির প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয়ও এত বেশি অগ্রিম কর দিতে হয় না। আবার সমন্বয়যোগ্য অগ্রিম কর নিয়েও বিড়ম্বনার শেষ নেই।

 

স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক তপন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অগ্রিম কেটে নেয়া আয়কর সমন্বয়ের বিষয়টি অনেক ঝামেলার। অগ্রিম কেটে রাখা হলেও পরে সমন্বয় খুব জটিল। এর ব্যয় অনেক বেশি। দুর্ভাগ্যবশত সরকারের কোষাগারে একবার টাকা গেলে সেটা বের করা অনেক সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বড়দের চাপ সামলানোর সক্ষমতা কম-বেশি থাকলেও যারা তুলনামূলক ছোট তাদের জন্য অনেক সমস্যা হয়। সম্ভাব্য মুনাফার ওপর যেটা অগ্রিম কেটে রাখা হচ্ছে সেটা সমন্বয়ে অনেক দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে, কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। অনেক ধরনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি সৃষ্টির প্রচেষ্টা রয়েছে বর্তমানে, সেই ধারাবাহিকতায় এ ধরনের বিষয়গুলো এখন দেখার সময় এসেছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে হয়রানি ও ভোগান্তিটা যাতে কম হয়।’

পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে বিভিন্ন হারে কাস্টমস ডিউটি (সিডি) বা আমদানি শুল্ক, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি (এসডি) বা সম্পূরক শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, অ্যাডভান্সড ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) বা অগ্রিম আয়কর, অ্যাডভান্সড ট্যাক্স (এটি) বা অগ্রিম কর ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হয়। কমার্শিয়াল ট্রেডারদের ক্ষেত্রে এটি ও এআইটি প্রযোজ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে ট্রেডাররা খুব অল্প মূল্য সংযোজন করেই বিক্রি করে ফেলে। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় যখন পণ্য সরবরাহের সময় উৎসে ১০ শতাংশ কর কেটে রাখা হয়, যদিও সে উৎসে কর পরিশোধ করেছে। অনেক সময় মূল্য সংযোজন যা হয়েছে তারচেয়ে বেশি কেটে রাখা হয়। তুলনামূলক ছোট ট্রেডারদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা বেশি দেখা যায়।

নিয়ম অনুযায়ী, সিমেন্ট, লৌহ বা লৌহজাত পণ্য, ফেরো অ্যালয় পণ্য বা সুগন্ধি, কার্বোনেটেড বেভারেজ, গুঁড়ো দুধ, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, সিরামিক পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্পোদ্যোক্তাদের কাঁচামাল হিসেবে আমদানীকৃত পণ্যের ওপর নেয়া অগ্রিম আয়কর পরে সমন্বয় করা হয়। অন্যদের ক্ষেত্রে এমন সুযোগ রাখা হয়নি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তারা বলছেন, করদাতাদের সুবিধার জন্যই অগ্রিম কর চালু করা হয়েছে। কিস্তিতে তারা কর পরিশোধ করতে পারেন, যা বছর শেষে হিসাব সমন্বয় করা হয়। আর অগ্রিম কর নেয়া হলেও তা পুরোপুরি সমন্বয় না অভিযোগ আংশিক সত্য। তবে বেশির ভাগই অর্ধ সত্য।

এনবিআরের একজন কমিশনার বলেন, করদাতাদের সুবিধার জন্যই অগ্রিম কর চালু করা হয়েছে। কিস্তিতে তারা কর পরিশোধ করতে পারেন। বছর শেষে হিসাব সমন্বয় করা হয়। অগ্রিম কর নেয়া হলেও ফেরত দেয়া হয় না ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগের বিষয়ে এনবিআরের কাস্টমসের এক কর্মকর্তার মতে, ‘অভিযোগ আংশিক সত্য। তবে বেশির ভাগই অর্ধ সত্য। একদিকে ফেরত পাবে না ধরে নিয়ে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে তা উসুল করে দেয়, যা ফেরত পেল তাই লাভ।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে অগ্রিম কর আদায়ের সংস্কৃতি বেশ পুরনো। ব্রিটিশ আমল থেকেই রাজস্ব আহরণে এর চর্চা হয়ে আসছে। সহজে রাজস্ব আহরণের জন্য এটি বেশ কার্যকর পদ্ধতি। এনবিআরের সদস্য (করনীতি) একেএম বদিউল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর অনেক আগে থেকেই চালু আছে। উৎসে কর কর্তনও ১৯২২ সাল থেকেই চালু আছে। তখন খাত কম ছিল। পরে খাত বেড়েছে। এগুলো আমাদের উপমহাদেশে চলমান। ভারতে তো আরো বেশি খাতে উৎসে কর কর্তন করা হয়। অগ্রিম কর রিফান্ডের বিধান আইনেই রয়েছে। তারপরও কখনো কখনো অভিযোগ ওঠে। আবার রিফান্ড দিলেও সমালোচনা হয়।’

তবে কর পরিশোধকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বেসরকারি খাতের আকার স্ফীত হওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক সংযোগও বেড়েছে। নিত্যনতুন ইস্যুর প্রভাব দেখা যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কভিড, সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট, ডলারের প্রাপ্যতার সংকটের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, সুদহার বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো ব্যবসার খরচ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় অগ্রিম কর অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের জন্য চাপের কারণ হয়ে উঠছে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে অগ্রিম কর সমন্বয় করা নিয়ে মারাত্মক জটিলতায় পড়তে হয়।

অগ্রিম কর সমন্বয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এনবিআরের একজন সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুল্ক করাদি অব্যাহতি পাওয়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে পরিশোধিত এটি পরে পরিশোধ করে দেয়া হয়। তবে বিক্রির উদ্দেশ্যে আনা পণ্য আমদানির সময় পরিশোধিত অগ্রিম কর ফেরত দেয়া হয় না। পণ্য উৎপাদন করে তা বিক্রির জন্য আনা কাঁচামাল আমদানির সময় পরিশোধিত আয়কর পরে ছয় কর মেয়াদে সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে সমন্বয় করা না গেলে তা প্রতিষ্ঠানের আবেদনের ভিত্তিতে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তা ফেরত দেয়া হয়।’

টেক্সটাইল খাতসংশ্লিষ্ট এক সূত্রের ভাষ্যমতে, সুতা রফতানিকারকের ক্ষেত্রে উৎসে কর কেটে রাখা হয় দশমিক ৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে উৎসে কেটে নেয়া অগ্রিম কর কিংবা করযোগ্য মুনাফার ওপর আরোপিত করের মধ্যে যেটির পরিমাণ বেশি, সেটিকেই চূড়ান্ত কর হিসেবে ধার্য করা হয়। পরে আর এটি সমন্বয়ের সুযোগ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যেকোনো বছরে যে পরিমাণ মুনাফা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কর আগেই নেয়া হয়ে গেছে। অগ্রিম করের কারণে স্পিনিং, নিটিং, রি-রোলিং মিল, সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে যাদের মূল্য সংযোজন কম, তাদের ওপর অগ্রিম করের চাপ বেশি।

আয়কর আইনের ১৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, অগ্রিম কর হিসাবে পরিশোধযোগ্য ন্যূনতম কর চারটি সমান কিস্তিতে পরিশোধ করা যায়। এর মধ্যে অর্থবছরের ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৫ ডিসেম্বর, ১৫ মার্চ ও ১৫ জুন প্রতি কিস্তিতে অগ্রিম করের ২৫ শতাংশ করে পরিশোধ করা যায়। এছাড়া আইনে ৫৩ ধরনের উৎসে কর কর্তনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো অগ্রিম কর হিসেবেই কাটা হয়।

বিশ্বের উন্নত দেশে এত অগ্রিম কর নেই বলে মন্তব্য করেছেন এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন। এনবিআর সংস্কার কমিটির এ সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বেতনের ওপর শুধু উৎসে কর কর্তন করা হয়। আমাদের এনবিআরও এখন রাজি হয়েছে উৎসে কর কর্তনের খাতগুলো কমিয়ে আনবে। আমরা এনবিআর সংস্কার কমিটিও সেই সুপারিশ করব। মূলত আয়কর খাতে অগ্রিম কর বেশি। কাস্টমস খাতে কোনো অগ্রিম কর নেয়া হয় না। ভ্যাট খাতে শুধু অ্যাডভান্স ট্যাক্স (এটি) নামে অগ্রিম কর কর্তন করা হয়।’

উৎসে কর দুই ধরনের। একটা চূড়ান্ত, আরেকটি সমন্বয়যোগ্য। যেটা চূড়ান্ত কর সেটি আর ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। আর সমন্বয়যোগ্য করের ক্ষেত্রে পাওনা হলে ফেরত দেয়ার কথা। যদিও ব্যবসায়ীদের অগ্রিম কর সমন্বয়ের ক্ষেত্রে নানা জটিলতায় পড়ার অভিযোগ সম্পর্কে ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘অগ্রিম কর কোম্পানির ও সরকারের সুবিধার জন্যই চালু করা হয়েছে। কিস্তিতে কর আদায় করা হয়। বছর শেষে সেটি সমন্বয় করে পাওনা হলে দিয়ে দেয়ার নিয়ম। এনবিআর পাওনা হলে করদাতা পরিশোধ করে দেবেন।’

অনেকটা একই বক্তব্য ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরীর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অগ্রিম কর পরিশোধের পর সমন্বয়কৃত অর্থের পরিমাণ নিয়ে কোম্পানি ও এনবিআরের মধ্যে বিরোধ বা মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে। কিন্তু অর্থ সমন্বয় হয় না বললে অন্যায্য বলা হবে। তবে পুঁজিঘন শিল্পের উদ্যোক্তারা বলতে পারেন যে আমি আগেই কর দেব কেন? আমি বছর শেষে একবারে পরিশোধযোগ্য কর দেব। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারেরও অর্থের প্রয়োজন রয়েছে, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে সারা বছরই কর দিতে পারে। বছর শেষে রিফান্ডও দেয় তারা। আমাদের এখানেও চার কিস্তিতে দিতে পারে। এছাড়া উৎসে করও কর্তন করা হয়। রাজস্ব আহরণের সহজ পথ উৎসে কর কর্তন। সহজে তো নিয়েছি, ফেরত দেয়ার বেলায় হিসাব করে দেই, এ মানসিকতা। অর্থবছর শেষে সমন্বয় করে ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে দেরি করা হয় বা দেয়া হয় না। ফাইল অডিট করে কষ্ট করে কর আহরণ করতে চায় না অনেকে। আমরা সংস্কার কমিটি থেকে সুপারিশ করব এসব বিষয়ে।’