
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে থাকা সরকারি প্লট বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্লটগুলো বাতিলের বিষয়ে বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান খতিয়ে দেখে সুপারিশ তৈরি করতে একটি কমিটি করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্র আমার দেশকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
শেখ হাসিনা নিজে ও তার ছোট বোন শেখ রেহানার এবং তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে রাজউকের পূর্বাচল উপশহরের কূটনৈতিক জোনে ১০ কাঠা করে ৬০ কাঠার ছয়টি প্লট বরাদ্দ নেন। পরিবারের ছয় সদস্যের নামে এসব প্লট বরাদ্দ নিতে গিয়ে তিনি (শেখ হাসিনা) প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার, মিথ্যা হলফনামা দেওয়া ও রাজউকের বিদ্যমান আইন ভঙ্গ করেছেন বলে জানিয়েছেন রাজউকের কর্মকর্তারা।
ভবিষ্যতে যাতে কেউ আর বিশেষ কোটায় ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিতে না পারেনÑএজন্য রাজউকের বরাদ্দ বিধিমালা ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নীতিমালা সংশোধন করছে সরকার। ইতোমধ্যেই এ সংশোধনীর খসড়া তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
যেসব আইন ভেঙেছেন হাসিনা
তদন্ত কমিটির একজন সদস্য আমার দেশকে জানান, সরকারের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ও পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে বহাল থাকাকালে শেখ হাসিনা তার ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এর মধ্য দিয়ে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন হাসিনা।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি এসব প্লট অবৈধভাবে নিজেদের দখলে রেখে তার পরিবারের অপর পাঁচ সদস্যÑছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকও আইন ভঙ্গ করে অনুরূপ অপরাধ করেছেন।
১৯৮৪ সালের রাজউক বিধিমালা উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা জানান, সরকার মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা সমমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী, সরকারি কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী, সাংবাদিক, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকরিজীবী, বেসরকারি শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, আইনজীবী, কৃষিবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, চিকিৎসক ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক প্লট সংরক্ষণের জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারবে।
তবে আবেদনকারীকে বাংলাদেশি নাগরিক হতে হবে এবং ঢাকায় আবেদনকারী বা তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের জমি কিংবা প্লট থাকলে তিনি আবেদন করার যোগ্য হবেন না। শেখ হাসিনা ও রেহানাসহ তাদের পরিবারের ছয়জনই এ বিধিমালা লঙ্ঘন করেছেন।
রাজউকের আরেক কর্মকর্তা জানান, বিধিমালা অনুযায়ী আবেদনকারীকে হলফনামায় উল্লেখ করতে হবে, ‘ঢাকা শহরে তার নিজের নামে কিংবা পরিবারের অন্য কারো নামে কোনো প্লট নেই। পাশাপাশি ‘স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তার একটি প্লট দরকার’ এ তথ্যটিও জানাতে হবে। শেখ হাসিনা, রেহানা ও তাদের পরিবার তথ্য গোপন করে অবৈধভাবে এসব প্লট নিয়েছেন। ঢাকায় কোনো জমি বা প্লট নেই বলেও তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন, জানান ওই কর্মকর্তা।
বাতিল হচ্ছে বিশেষ বরাদ্দের বিধান
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ভূমি, প্লট, স্পেস ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ) বিধিমালা সংশোধন করে সব ধরনের বিশেষ বরাদ্দ বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিধিমালার ধারাগুলো বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে সংশোধনীর খসড়ায়।
বিদ্যমান বিধিমালায় রাজউকের আওতাধীন যে কোনো প্রকল্পের আবাসিক প্লটে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর ও সংস্থার কর্মচারীদের জন্য দুই শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিধান ছিল। এ ছাড়া মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী বা সমমর্যাদার ব্যক্তি, সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সরাসরি সদস্য এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে বা কর্তৃপক্ষের আইন প্রণয়ন কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেনÑ এমন সরকারি কর্মচারী বা পেশাজীবী, যিনি জনসেবা বা জনকল্যাণে ভূমিকা রেখেছেন, তারা রাজউকের প্লট বরাদ্দ পাবেন বলে উল্লেখ ছিল। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এসব বিধান বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধিক্ষেত্রভুক্ত সম্পত্তি বা জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগও নিয়েছে গৃহায়নও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বিশেষ বরাদ্দ বা কোটাভিত্তিক বরাদ্দের বিধান বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান আমার দেশকে বলেন, আমরা বিশেষ বরাদ্দের বিধান রাখতে চাই না। কারণ এ বিধানগুলোর অপব্যহার করে দেশের মূল্যবান সম্পদ বা প্লট অবৈধভাবে দখল করা হয়।
শেখ হাসিনা ও রেহানার পরিবারের সরকারি প্লটের বরাদ্দ বাতিলের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. আব্দুর রহমান তরফদার আমার দেশকে বলেন, প্লটগুলো বরাদ্দে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। দুদক তদন্তের জন্য আমাদের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত সব নথি নিয়ে গেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শুধু প্লট বাতিলই নয়, অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও হতে পারে।