Image description

তানজিল রহমান (Tanzil Rahman)

 
মাস খানেকের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছিলেন ২০১৪ সালে আমাকে বুয়েট ছাত্রলীগের যারা টর্চার করেছিলো তাদের নামে মামলা করার জন্য। দেশে গেলে অনেক রকম ব্যস্ততা থাকে। তারপরেও মামলা করার নিয়ত করলাম।
যেহেতু ঢাকার বাইরে বাড়ি, বার বার ঢাকায় যাওয়া ঝামেলা ভেবে একদিনেই মামলা করে ফিরে আসবো চিন্তা করলাম। মামলা করতে প্রথমেই সাক্ষী লাগবে। আমাকে ডিপার্ট্মেন্টের সব শিক্ষকের সামনে মেরেছিলো, তাই সাক্ষীর অভাব হবে না ভেবেছিলাম। ডিপার্ট্মেন্টে গেলাম।
 
বুয়েটের বেশিরভাগ শিক্ষকই চিরাচরিত ভীতু এবং ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া আচরণ দেখালেন। এর মধ্যেও কয়েকজন শিক্ষক দারুণ সহায়তা করলেন এবং সাক্ষী হতে সম্মতি দিলেন। কিন্তু অনেকের সাথে দেখা করে সাক্ষী হতে রাজি করাতে গিয়ে দিনটা পার হয়ে গেলো। সেদিন আর থানায় যেতে পারলাম না।
 
মামলার এজাহার লিখে সপ্তাহ খানেক পরে আবার ঢাকায় গেলাম। বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগ শাহবাগ থানার মধ্যে পড়ে। সকাল সকাল গেলাম শাহবাগ থানায়। থানায় ওসি নাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে তদন্ত কর্মকর্তা আসাদ সাহেবকে পেলাম। সব শুনে আর এজাহার দেখে তদন্ত কর্মকর্তা বললো- এত আগের ঘটনা এত দিন পরে এভাবে মামলা নেওয়া যায় নাকি? আপনার মেডিকেল সার্টিফিকেট কোথায়? আমি বললাম আপনারা এজাহারের ভিত্তিতে তদন্ত করলেই তো বের হয়ে আসবে ঘটনার সত্যতা। তখন ঠিক মতো চিকিৎসা নেওয়ারও সুযোগ পাই নি, আবার এত দিন আগের চিকিৎসার কাগজ পত্রও তো রাখি নি। বিচার চাওয়ার সুযোগ পাবো এই আশাই তো করি নি কোনোদিন। কিন্তু তিনি মামলা নিলেন না কোনভাবেই।
 
কি আর করা! হাল না ছেড়ে ঢাকা মেডিকেলে গেলাম মেডিকেল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করতে। ডা. কায়েস ভাইয়ের সহয়তায় অর্থোপেডিক্স বিভাগে গিয়ে আমার এত দিন আগের ভাঙ্গা হাতের এক্সরে করিয়ে তার উপরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কমেন্ট নিয়ে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা হলো।
 
যেহেতু প্রশাসন এখন জামায়াতের দখলে বলে শোনা যাচ্ছে, জামায়াতের মাহফুজ ভাইকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যায় আবার শাহবাগ থানায় গেলাম। ওসি মনসুর খালিদ সাহেবকে এবার পাওয়া গেলো। মাহফুজ ভাইয়ের জামায়াতী প্রভাবে কোন কাজ হলো না। ওসি বলে দিলো এত আগের ঘটনায় মামলা নেওয়া যাবে না এখন। ওনারা অনেক চাপে আছে, এত আগের ঘটনায় এভাবে মামলা নিলে পুলিশের নামে সমালোচনা
 
হবে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো মামলা নিলেও আপনি তো আমেরিকা থাকেন, সাক্ষী দিতে আসবেন কিভাবে? আমি বললাম মামলা করতে যেহেতু আসতে পারছি, সাক্ষী দিতেও এভাবেই আসবো!
 
পরে বার বার অনুরোধ করতে থাকায় মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখে মামলা না নিয়ে একটা অভিযোগ জমা দিয়ে যেতে বললো ওসি। অভিযোগ ডিউটি অফিসারের কাছে জমা দিলে সেই এসআই স্বপন মিয়ার ফোন নাম্বার দিয়ে আমাকে বললো স্বপন মিয়া আপনার অভিযোগ দেখবে। এই নাম্বারে ফোন দিয়েন দুই দিন পরে। উনি এখন থানায় নেই, ডিউটিতে গেছে।
 
প্রচন্ড ব্যস্ততায় দেখতে দেখতে দেশ ছাড়ার সময় হয়ে গেলো। কয়েকদিন পরে ইউএসএ ফিরে এসে স্বপন মিয়াকে ফোন দিলে উনি বললেন আমার জমা দেওয়া এমন কোনো অভিযোগ তার কাছে যায় নি। এই হলো মোটামুটি ইউএসএতে বসবাসরত একজন ন্যায়বিচার প্রার্থী বাংলাদেশির বিচার পাওয়ার প্রচেষ্টার ইতিবৃত্ত।
 
এই পুলিশ যখন ১৯ জুলাই শহীদ হওয়া রিকশাচালক ইসমাইলকে হত্যার জন্য কোনো পুলিশকে গ্রেফতার না করে ডা. সাদীকে গ্রেফতার করে কিংবা ১৮ জুলাই পুলিশের এপিসি থেকে ফেলা দেওয়া এমআইএসটির ছাত্র শহীদ ইয়ামিনের মৃত্যুর জন্য পুলিশকে অব্যহতি দিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দেয়, আমি আর অবাক হই না।
 
ইউনূস সরকার ক্ষমতায় বসার পর পর বুয়েটে ছাত্রলীগের নির্যাতনগুলোর তদন্তে একটা কমিশন করেছিলো। সেই কমিশনও ফাংশন করে নি। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সময় আমার শুধু মনে হতো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো যদি এমন নিরাপদ হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি শিক্ষার্থীরা নিশ্চিন্তে না যেতে পারে তাহলে পড়াশুনা করবে কিভাবে। অথচ গত দশকে ঘটা এই নির্যাতনগুলোর বিচার না হলে নিরাপদ ক্যাম্পাস কোনোভাবেই নিশ্চিত হবে না। সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন নামে বিভিন্ন দলের ছত্রছায়ায় এই নির্যাতনের সিলসিলা বার বার ফিরিয়ে আনার সাহস করবে।
 
আমার উপরে নির্যাতনের ঘটনার বিস্তারিত-
২০১৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বুয়েটের বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগের ফাউন্ড্রি ল্যাবে (শাহবাগ থানার আওতাধীন) একাডেমিক এসাইনমেন্টের কাজে গিয়েছিলাম। ল্যাবের গেটে আবু সাঈদ কনক (মেকানিকাল ১০, ঠিকানা- পাবনা, বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক), প্রতীক দত্ত (সিভিল ১১, বর্তমানে গোপালগঞ্জ কোটালীপাড়া এসি ল্যান্ড), আবু আনাস শুভম (মেকানিকাল ০৯), সিয়াম হোসেন (মেকানিকাল ০৯), ফাইরুজ চৌধুরী (সিভিল ০৬, যুক্তরাষ্ট্রের ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিরত) ও শুভ্রজ্যোতি টিকাদার (মেকানিকাল ০৯, মৃত) আরও ৮-১০ জন বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের নিয়ে আমার উপরে হামলা চালায়। হামলা থেকে বাঁচতে আমি ল্যাব সংলগ্ন গার্ড রুমে ঢুকে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিই এবং হট্টগোল করে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করি। আমার চিৎকার শুনে বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগের প্রায় সব শিক্ষক ও কর্মচারী উপস্থিত হন।
 
কিছুক্ষণ পরে তৎকালীন ছাত্রকল্যান পরিচালক (প্রক্টর) ড. মোঃ দেলোয়ার হোসেন সেখানে উপস্থিত হলেও আমাকে উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে চলে যান। এর পরেই উপরে উল্লেখিত বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের মধ্যে সিয়াম হোসেন, আবু আনাস শুভম ও ফাইরুজ চৌধুরীর নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে গার্ড রুমের দরজা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে আমাকে বের করে এবং আবু সাঈদ কনক, প্রতীক দত্ত ও শুভ্রজ্যোতি টিকাদার সবাইকে সাথে নিয়ে লাঠি ও রড দিয়ে আমাকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে পেটাতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে বুয়েটের তৎকালীন রেজিস্ট্রার (বর্তমান ছাত্রকল্যাণ পরিচালক) ড. একেএম মাসুদ উপস্থিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়ে সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করে তৎকালীন উপাচার্য খালেদা একরামের অফিসে নিয়ে যান।
 
আমার উপরে হামলার মাস খানেক আগে বুয়েট ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসীরা তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখির কারণে হুমকি দেয়। এই হুমকির পরে আমি তৎকালীন বস্তু ও ধাতব কৌশলের বিভাগীয় প্রধানের পরামর্শে তৎকালীন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. মোঃ দেলোয়ার হোসেনের নিকট নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন দিলেও তিনি তখন কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেন নি। হামলা ও নির্যাতনের আগের দিন আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় র্যাগিং এর সময় জোর করে সালাম দেওয়ার বিরুদ্ধে লিখলে হামলাকারীরা আমার উপরে আবারও ক্ষুব্ধ হয়। হামলার সময়ও দায়িত্বরত ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. মোঃ দেলোয়ার হোসেন কোনো রকম পদক্ষেপ নেন নি, বরং পরবর্তীতে উপাচার্যের কক্ষে এসে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখার জন্য আমাকেই তিরস্কার করে।