রাজধানীর গণপরিবহণের শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নানামুখী চাপে ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে-এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, ইতোমধ্যেই সরকারের বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে নিজেদের মতো করে সড়কে বাস পরিচালনা শুরু করেছেন মালিকপক্ষ। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এই অনিয়মকে সরাসরি সহযোগিতা করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশন ব্যতীত ঢাকার গণপরিবহণের শৃঙ্খলা ফেরানোর বিকল্প কোনো পথ নেই। সরকার গঠিত কমিটির মাধ্যমে এর সমাধান খুঁজতে হবে। ওই কমিটিতে যদি কোনো গলদ থাকে, তাহলে সেটা সমাধান করে তার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে।
তিনি বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) ঢাকায় পরিবহণ মালিকরা টিকিট ও কাউন্টার সিস্টেমে বাস পরিচালনা শুরু করেছেন। আর কোনো ধরনের বিবেচনা না করে ওই কাজে সহযোগিতা করছে পুলিশ। এখানে একটা কথা চাউর রয়েছে যে-পুলিশের অনেকে পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে তারা পরিবহণ মালিকদের পক্ষে অবস্থান নেয়। অথচ তাদের ভূমিকা নেওয়া দরকার ছিল নগরবাসীর পক্ষে। পরিবহণ মালিক এবং পুলিশের বিষয়গুলো সরকারকে কঠোরভাবে জবাবদিহি করা দরকার। নইলে তো আগের সরকারের সময়ের মতো হয়ে যাবে সবকিছু। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গণপরিবহণের বিশৃঙ্খলার কারণে ঢাকায় যানজট বাড়ছে। রয়েছে পরিবহণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা; এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু প্রাণ। পঙ্গুত্ববরণ করে প্রতিবছর দুর্বিষহ যন্ত্রণার জীবন বরণ করছেন শত শত মানুষ। এই অবস্থার উত্তরণে ৫ বছর আগে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। নানামুখী চাপ এবং কিছু ক্ষেত্রে ভুলপথে কার্যক্রম পরিচালনায় বিশ্বে স্বীকৃত এই পদ্ধতির ঢাকায় বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জে পড়ে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পরে সঠিক পথে চলতে থাকা এই উদ্যোগ নতুন চ্যালেঞ্জে পড়েছে।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সংশ্লিষ্টরা জানান, বাস রুট রেশনালাইজেশনের পদ্ধতিতে সমন্বয় করে কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া রুটে শুধু নির্ধারিত কোম্পানির বাস চলাচল করে। ওই রুটে অন্য কোন বাস বা গণপরিবহণ চলাচল করে না। এতে সড়কে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে না। যাত্রীরা শৃঙ্খলিতভাবে টিকিট কেটে বাসে চলাচল করেস। অর্জিত মুনাফা কোম্পানিগুলোকে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। এ সুবিধা পেতে সব রুটে একত্রে তা চালু করতে হয়।
তারা জানান, ঢাকার বাস রুট রেশনালাইজেশনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি না মেনে ৩টি রুটে ঢাকা নগর পরিবহণ নামে বাস চালু করলেও সফলতা মেলেনি। এজন্য ৩টি রুটে ইতোমধ্যে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। লাভজনক না হওয়ায় শুরুতে সব রুট থেকে বেসরকারি বাস চলে যায়। এরপরও বিআরটিসির বাস দুটি রুটে চললেও তাদের লোকসান হচ্ছিল। চমৎকার পদ্ধতির ভুল বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ার পথে ঢাকার বাস রুট রেশনালাইজেশন উদ্যোগ। সফলতা পেতে হলে ভুল সংশোধন করে সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সে কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। তবে এই সময়ে পরিবহণ মালিকরা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকা যানবাহন কর্তৃপক্ষ বা ডিটিসিএ এবং সরকারের কমিটিকে থোড়াই কেয়ার করে সড়কে পুরাতন বাসগুলোতে কমলা রং করে চালানো শুরু করায় চালেঞ্জে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তারা বলেন, ২০১৫ সালে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ঢাকায় বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। সে সময় তিনি ২৫টি সভা করে বাস মালিকদের রাজি করিয়েছিলেন। তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ঢাকার ১৭৪টি বাস রুটকে ২২টিতে এবং সহস্রাধিক বাস কোম্পানিকে ৬টিতে নামিয়ে আনা হবে। একই সঙ্গে ৩ হাজার ৭৬৬টি ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় বাস সড়ক থেকে তুলে নেওয়া হবে। পরিবর্তে ঢাকায় আধুনিকমানের ৪ হাজার বাস নামানো হবে। পরিবেশবান্ধব ও দক্ষতার সঙ্গে গণপরিবহণ ব্যবস্থাপনার জন্য ৪টি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, ৬টি সিটি বাস টার্মিনাল ও ২টি ট্রেনিং একাডেমি তৈরি করা হবে। এসব কাজ করতে ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। বলা হয়, ৬৫০ কোটি টাকা নতুন বাস ক্রয় বাবদ ভর্তুকি দেওয়া হবে। বাকি টাকা অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ হবে। আর বাস মালিকদের নতুন বাস ক্রয়ে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বিদেশি ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনার কথাও আলোচনা হয়েছিল। সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের সময়ে তারা বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি মূল জায়গা থেকে সরিয়ে নেয়। যার ফলে পরিবহণ মালিকরা তাদের উদ্যোগ বাস্তবায়নে অসহযোগিতা করেছেন। এখনো দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ডিটিসিএ মূল বিষয়টি ধারণ করছে না। শুরুর বিষয়টি ধারণ করে পরিবহণ মালিকদের সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। তাহলে কার্যত সফলতা মিলবে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ঢাকার গণপরিবহণের শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ বাস্তবায়নের সমন্বয়ক সংস্থা ঢাকা যানবাহন কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার ধ্রুব আলম যুগান্তরকে বলেন, পরিবহণ মালিকরা বাস রুট রেশনালাইজেশনসংক্রান্ত কমিটির সভায় একসঙ্গে কাজ করার সম্মতি প্রকাশ করে এসেছেন। পরে আবার পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে টিকিট ও কাউন্টার সিস্টেমে বাস পরিচালনা শুরু করেছেন। যেটা তারা করতে পারেন না। ডিটিসিএ চাইলে আইনগতভাবে তা রুখে দিতে পারে। তবে একটি সরকারি সংস্থা হিসাবে তা করতে চাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ডিটিসিএ গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির পরামর্শে ২৫ ফেব্রুয়ারি ৮ রুটে শৃঙ্খলিতভাবে বাস পরিচালনা শুরু করবেন। সে লক্ষ্যে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আমরা জনবান্ধব এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সবাইকে পাশে চাই। সরকার চাইলে এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও যুক্ত করতে পারে। এতে করে দ্রুত সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ডিটিসিএ বা বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির উদ্যোগ কার্যত কোনো সুফল মিলছে না। আর বাসের বিশৃঙ্খলা ও নোংরা অবস্থার জন্য যোগাযোগ উপদেষ্টা আমাদের তা সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। ডিটিসিএ পারলে আমাদের এসব করার প্রয়োজন পড়ত না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক) সুফিয়ান আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির কোনো সিদ্ধান্ত অমান্য করে পরিবহণ মালিকরা বাস পরিচালনা করছে না। রুট, বাস ও রং সবই ঠিক আছে। সরকারি সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও ডিটিসিএর বাইরে গিয়ে পরিবহণ মালিকদের সহযোগিতার কারণ কী-এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, যেহেতু কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। এজন্য পুলিশ পরিবহণ মালিকদের সহযোগিতা করেছে। এর বাইরে পুলিশের কোনো উদ্দেশ্য নেই। পুলিশের অনেকে গাড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ পরিবহণ মালিকদের সহযোগিতা করছে-এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ ধরনের কথার কোনো যৌক্তিকতা নেই। পুলিশ শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালন করছে। এর বাইরে কিছু নয়।