Image description

বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শেষ হয়েছে গত ৩রা ফেব্রুয়ারি। তবে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার অনেকেই ভোটার হালনাগাদে নিজেদের যুক্ত করতে পারেননি। এদের মধ্যে আছেন বিদেশগামী, বিদেশ ফেরত তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী, মধ্য বয়সী পুরুষ ও নারী। এর মধ্যে গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই হালনাগাদ প্রক্রিয়া ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাড়ি বাড়ি যাওয়ার প্রক্রিয়া আর থাকছে না।
জানা যায়, ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অভাব, সার্ভারে ত্রুটি, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে জনপ্রতিনিধি না থাকার ফলে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জমা দিতে পারেননি বেশিরভাগ মানুষ। কোথাও কোথাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাগজপত্র আনতে বলায় বেকায়দায়ও পড়েছেন কেউ কেউ। এতে এবারো ভোটার না হতে পারার আক্ষেপে ডুবতে হচ্ছে অনেককে। 

অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া লোহাগাড়া, মিরসরাইসহ বিভিন্ন উপজেলায় ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি না গিয়ে তথ্য সংগ্রহের বদলে এক বাড়িতে, এক স্থানে বা স্কুলে বসেই আয়েশীভাবে কাজ সেরেছেন। আর এতেই বেশি হয়রানিতে পড়েন আবেদনকারীরা। 
সম্প্রতি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে এমন অভিযোগ আসতে থাকলে তা যাচাই-বাচাই করে দৈনিক মানবজমিন। সেই যাচাইয়ে উঠে আসে ভোটার হালনাগাদে নানা হয়রানি ও জটিলতাকরণ এবং তথ্য সংগ্রহকারীদের দায়িত্বে অবহেলা। একইসঙ্গে উঠে আসে আওয়ামী আমলে করা ভুলের কারণে ভোটার হতে না পারার অনিশ্চয়তায় থাকা বহু মানুষের আক্ষেপের কথাও। 

চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের কৈখাইন গ্রামের আব্দুল আজিজ ভোটার হতে তার এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগ্রহকারীর দেখা পেলেও গুরুত্বপূর্ণ সব কাগজপত্র জোগাড় করতে তার চারদিন সময় লেগে যায়। পরিষদে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা না থাকায় চেয়ারম্যানের পরিবর্তে সেখানকার সরকারি কর্মকর্তার স্বাক্ষর নিতেই তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। কেননা দায়িত্বপ্রাপ্তরা বাসিন্দা কিনা তা জানতেই দীর্ঘ সময় নিচ্ছেন। সেখানকার হালনাগাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরাও বাড়ি বাড়ি না গিয়ে স্কুলেই কার্যক্রম করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। একই চিত্র দেখা গেছে অন্যান্য ইউনিয়নেও। 
ওই উপজেলার হাইলধর গ্রামের বাসিন্দা মোজাফফর হোসেন দৈনিক মানবজমিনকে  বলেন, তার ছেলের জন্মনিবন্ধন অনলাইন করাতে পারছেন না। সেখানকার পৌরসভার কর্মচারীরাও তাকে সহযোগিতা করছে না। তাদের সাফ কথা এসব তাদের কাজ নয়। শেষমেশ অনলাইনে আবেদন করলেও তাকে ডিসি অফিসে পাঠানো হয়েছে। 

একই কথা বলেন আনোয়ার হোসেনও। তিনি বলেন, ভোটার হতে গিয়ে নানা ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে তাকে ও তার স্বজনদের। সম্পত্তির খতিয়ান আনতে না পারায় তিনি ভোটার হতে পারছেন না। অথচ এসব ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা রয়েছে, যা মেনে ভোটার হওয়া যাবে। 
ওই গ্রামের তথ্য সংগ্রহকারী মোহসেন আলী বলেন, শেষ দিনেও বেশির ভাগ নতুন আবেদনকারীরা কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ভোটারদের কাগজ জমা নিচ্ছি। বাড়ি বাড়ি না যাওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। 
আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের সুপারভাইজার উজ্জ্বল বোস বলেন, সোমবার স্কুল বন্ধের দিনেও তথ্য সংগ্রহকারীরা ভোটারদের কাগজপত্র জমা নিচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান না থাকায় ও সার্ভার জটিলতায় ভোটারদের সব কাগজ জোগাড় করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 

উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের সুপারভাইজার নুরুল আবছার বলেন,  তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য হালনাগাদ করছে। পাশাপাশি যাদের তথ্য এবং কাগজপত্র অসম্পূর্ণ তাদেরকে নির্দেশনা দিয়ে সেগুলো পূর্ণাঙ্গ করে আনতে বলা হচ্ছে। তবে বিভিন্ন জটিলতায় অনেক ভোটার এখনো সম্পূর্ণ কাগজ জমা দিতে পারছেন না। কিছু সময় যদি বাড়ানো হয় তবে তারা সেগুলো জমা দিতে পারবেন।

উপজেলা নির্বাচন অফিসার আবু জাফর ছালেহ বলেন, ২০শে জানুয়ারি থেকে ৩রা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। আনোয়ারা উপজেলায় ২২ জন সুপারভাইজার ও ১১০ জন তথ্য সংগ্রহকারী কাজ করছে। 

রোহিঙ্গা ভোটারের প্রবণতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত কোনো অভিযোগ বা তথ্য আসেনি। ভোটারদের ফরম ও তথ্য ফরম জমা হলে যাচাই-বাছাই করা হবে।

এদিকে সীতাকুণ্ডেও একই হাল ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে। পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড শিবপুরের বাসিন্দা আব্দুল কাদের  জানান, তিনি শহরে চাকরি করেন। সবাই তাকে বলেছেন  পাশের বাড়িতে বা কয়েক বাড়িতে আসার পরদিন তাদের বাড়িতে আসবেন। সেই হিসেবে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন সংগ্রহকারীর। কিন্তু সংগ্রহকারী আসেননি। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। 
৮ নম্বর ওয়ার্ডের জাহিদুল কবির বলেন, আমাকে অনলাইন জন্মনিবন্ধন করতে বলা হয়েছে। সেটি করতে গিয়ে পড়ি আরেক ঝামেলায়। সেখানে ইংরেজিতে আমার নামের বানান ভুল দেয়া হয়েছে। এটি সংগ্রহকারী মানছেন না। যেতে হবে শহরে ডিসি অফিসে। তাই এখনো পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে পারিনি। 

৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সুপারভাইজার শিক্ষিকা কনকা চৌধুরী বলেন, আমার অধীনে যারা ছিল তারা প্রত্যেকে বাড়ি বাড়ি গেছেন। তবে এটা সত্য যে অনেকে না গিয়ে কাজ সেরেছেন। এটা অস্বীকার করার জোঁ নেই। 
তিনি আরও বলেন, চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, কাউন্সিলর না থাকায় জটিলতা বেশি হচ্ছে। অনেকেই বাদ পড়েছেন। পূর্ণাঙ্গ তথ্য না দিলে আমাদেরও নেয়ার উপায় নেই। 
উপজেলায় ৪ নম্বর মুরাদপুর ইউনিয়নের হৃদয় হাসান বলেন, ভোটার হালনাগাদে তথ্য সংগ্রহকারীরাই অনেক কিছু জানেন না। এতে সমস্যা হচ্ছে বেশি। কোন বিষয়গুলো ছাড় দেয়া যাবে সেটি তারা বুঝছেন না। এতে জটিলতা বেশি বাড়ছে। আর না আসার অভিযোগ তো আছেই। 

৫ নম্বর বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের বাসিন্দা মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, চেয়ারম্যান প্রদত্ত নাগরিক সনদ পেতে সময় লাগছে। ততদিনে হালনাগাদকারী অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন। কেউ না বুঝে পরিষদে যাচ্ছে, কেউ উপজেলায়। হালনাগাদকারীরা দায়িত্বে দায়সারা ভাব দেখাচ্ছেন। 
এদিকে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে গিয়ে পড়েছেন চরম বেকায়দায়। তাদের ওই এলাকাটি নির্বাচন কমিশনের সরকারি অনলাইন সার্ভারেও না থাকায় ভোটার হওয়াতে জটিলতা দেখা দেয়। একদল শিক্ষার্থী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে গেলেও তিনি সমাধান দিতে পারেননি। পরে তারা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে এলে তিনিও এর সমাধান দিতে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে তাদের উপজেলা ঘেরাও কর্মসূচির ঘোষণার মুখে এনালগ পদ্ধতিতে তাদেরকে ভোটার হালনাগাদ করার সিদ্ধান্ত নেয় উপজেলা প্রশাসন।  
সেখানকার সলিমপুর স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি সংগঠন ইউএনও, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে সহযোগিতা চেয়েছেন। এরপরও তারা অনিশ্চয়তায় আছেন। 

সলিমপুরের শিক্ষার্থী মাহবুব রহমান বলেন, আমরা অনেকেই ভোটার হতে পারিনি। শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫ শতাধিক। আর সাধারণ মানুষসহ সংখ্যাটা ২ হাজারের বেশি। কেউই হালনাগাদ তথ্যে যুক্ত হতে পারেনি। তাদেরকে সেখানকার দায়িত্বরত শিক্ষক জানান, জঙ্গল সলিমপুরের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভোটার করলে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।

জঙ্গল সলিমপুরের একটি মাদ্রাসার পরিচালক আবদুল হক বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এখনো জন্ম নিবন্ধনও করতে পারেনি। এখানের মানুষ ভোটার হতে পারছে না, চেয়ারম্যান সনদ পাচ্ছে না, নাগরিক সনদ পাচ্ছে না। সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে এলাকার মানুষ বঞ্চিত বহুদিন ধরে। অথচ যারা নৌকায় বসবাস করে তারাও ভোটার হতে পারেন। ভূমিহীন সনদ দেয়ার পরও আমাদের ভোটার করছে না। ইউনিয়ন পরিষদে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় আমাদের। চরম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছি। অথচ এই দেশেই আমাদের জন্ম। 

সলিমপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড জঙ্গল সলিমপুরে ভোটার হালনাগাদ করার দায়িত্বে আছেন ছয়জন শিক্ষক। তারা কেউই কাউকে ভোটার করতে পারেননি। তাদের হাতে দেয়া ফরমগুলো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এস এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি আমাদের ছেলে-মেয়ে, ছাত্রছাত্রী কাউকেই ভোটার করতে পারিনি। আমাদের ফরমগুলো ফেরত দেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জানান যারা শিক্ষিত তাদের শিক্ষা সনদ জমা দেয়া হলে একটা চেষ্টা করে দেখবেন। তাও নিশ্চয়তা নাই। বেশির ভাগ মানুষ চেয়ারম্যান সনদ পাচ্ছেন না। উপজেলা থেকে বলা হচ্ছে এখানকার বাসিন্দারা সবাই অস্থায়ী, তাই চেয়ারম্যান সনদ দেয়া হবে না। এই অজুহাতে ভোটার হওয়া থেকে বঞ্চিত সকলে। 
এসব বিষয়ে জানতে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও প্রতিবারই তিনি সংযোগ কেটে দেন। 

এদিকে, ফটিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নেও বাড়ি বাড়ি না যাওয়ার এবং নানা জটিলতায় ভোটার হতে না পারার তথ্য এসেছে। একই চিত্র মিরসরাই, সন্দ্বীপ, হাটহাজারী উপজেলায়ও পাওয়া গেছে। 

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা অরুন উদয় ত্রিপুরা বলেন, আমরা গত ৩রা ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব শিক্ষকদেরকে মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ শেষ করে ফেলতে বলেছি। তাদেরকে বলা হয়েছে তারা যেন উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে এসব কাজ করেন। কেননা বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কাজ শেষ।

চট্টগ্রাম জেলার সিনিয়র নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ বশির আহমেদ দৈনিক মানবজমিনকে বলেন, বাড়ি বাড়ি না যাওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। এটা আমি মানতে পারবো না। অনেক ক্ষেত্রে ভোটার হতে ইচ্ছুকরাই বাড়িতে না থেকে সংগ্রহকারীদের দোষ দিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, যারা বাদ পড়েছেন তারা উপজেলায় এসে তথ্য জমা দিয়ে ভোটার হতে পারবেন। আপাতত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হালনাগাদ করার কার্যক্রম শেষ। এরপর শুরু হচ্ছে ছবি তোলার পর্ব।

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটার হালনাগাদকরণ প্রক্রিয়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হয়েছে ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ। তবে প্রাপ্তবয়স্ক যারা এখনো ভোটার হতে পারেননি তাদের জন্য ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত সুযোগ বাড়িয়েছে ইসি। তবে তাদেরকে ভোটার রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রে অথবা সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ যোগাযোগ করে ভোটার হতে হবে।