ভূমিকম্পে উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর ছয় লাখ ভবন। আরো ৩২১টি ভবন রয়েছে অতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকার এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম গতকাল শনিবার বংশালের কসাইটুলিতে একটি ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শনের পর এসব কথা জানান।
রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, শহরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত ও অপসারণ- দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। খুব শিগগির রাজধানীর সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, ভূমিকম্প-সংবেদনশীল রাজধানীর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলেছে অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা। একই সঙ্গে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব ভবন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্পে রাজধানীতে ক্ষতিগ্রস্ত ১৪টি ভবন
ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের পক্ষ থেকে শুক্রবারের ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানে ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর জানানো হয়েছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার সালাহ উদ্দীন-আল-ওয়াদুদের স্বাক্ষর করা একটি বার্তায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের প্রাথমিক তালিকা উল্লেখ করা হয়। তাতে দেখা গেছে, রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, আরমানিটোলা, সূত্রাপুর, বনানী ও কলাবাগানসহ মোট ১৪টি এলাকার ১৪টি ভবন শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাজধানীতে ছয় লাখ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ
রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্প নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক সমীক্ষা আরো একবার আতঙ্ক বাড়িয়েছে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে। সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রায় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে বহু ভবন নির্মাণ হয়েছে নিয়মকানুন না মেনে, পুরোনো নকশায় বা দুর্বল ভিত্তির ওপর। ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালের সিডিএমপি–জাইকা জরিপে জানা গেছে, রিখটার স্কেলে ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। এছাড়া আরো এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অন্যদিকে রাজউকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ছয় লাখ বহুতল ভবন (৪-৩০ তলা) উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ এগুলো নির্মাণের সময় যথাযথ নিয়মকানুন মানা হয়নি বা দুর্বল ভিত্তির ওপর নির্মিত। রাজউকের তথ্যমতে, ২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়। পরে ২০১৮ সালে তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়।
রাজউকের সেই হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। এর বেশির ভাগই রয়েছে পুরান ঢাকায়। এর মধ্যে সূত্রাপুর থানা এলাকায় ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি ও লালবাগে ২৮টির অবস্থান। বাকি ২১টির মধ্যে মোহাম্মদপুরে ছয়টি, ডেমরায় তিনটি, মিরপুরে সাতটি, রমনায় একটি, তেজগাঁওয়ে একটি, মতিঝিলে দুটি ও ধানমন্ডিতে একটি ভবন। এছাড়া বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন রয়েছে পাঁচ হাজার।
এদিকে ২০২৪ সালে ঢাকা অঞ্চলের ২১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩০ ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রাজউক। রাজউক আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের অংশ হিসেবে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুর ফল্টে (টাঙ্গাইল), ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকা শহরের প্রায় আট লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। দিনের বেলায় এমন ভূমিকম্প আঘাত হানলে প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে এবং দুই লাখ ২৯ হাজার মানুষ আহত হতে পারে বলে জানিয়েছে রাজউক।
জরিপটি ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা শহরের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পরিচালিত হয়েছে। রাজউকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ২ দশমিক ৬২ ট্রিলিয়ন টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো সংস্কার ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে আরো ৪৪ বিলিয়ন ডলার (৪ দশমিক ৬২ ট্রিলিয়ন টাকা) ব্যয় করতে হবে।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদদের বক্তব্য
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য বিশিষ্ট নগর ও পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব আমার দেশকে বলেছেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পের মাত্রা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগামীতে ভূমিকম্পের মাত্রা ৯ ছাড়াতে পারে এবং ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে পুরান ঢাকার অর্ধেক ভবন। কেননা ড্যাপের সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীর ৯৪ শতাংশ ভবন অননুমোদিত এবং নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে ৫৫ শতাংশই ভূমিকম্পের অতি উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব আমার দেশকে আরো বলেছেন, ‘ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে ঢাকাসহ সারা দেশে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে হবে। তিনি এ জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব করেছেন। এর পাশাপাশি, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা হবে কি না, তা নির্ধারণের নীতিমালা চূড়ান্ত করা এবং অবৈধ ভবন বৈধকরণের প্রক্রিয়াও এ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সম্পন্ন করার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি সিভিল ডিফেন্স গঠনেও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বেড়ে যাওয়ার পেছনে অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থাকে দায়ী মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। আমার দেশকে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা নিয়ম পরিবর্তন করে, ঢাকা শহরের ফিজিক্যাল প্ল্যান পরিবর্তন করে আরো বড় বড় ভবন বানাচ্ছে। রাস্তার পাশেই উচ্চ-ঝুঁকির ভবনের লাইসেন্স নিয়ে নিচ্ছে। এসব বিষয় যাদের দেখার কথা, যারা দায়িত্বে আছে, তারা আসলে কতজনকে আইনের আওতায় আনতে পেরেছে? যারা দুর্নীতি করেছে, তাদের কাউকেই আমরা আইনের মুখোমুখি করতে পারিনি। বড় বড় পদে থাকা যেসব কর্মকর্তা এসবের জন্য দায়ী ছিলেন, তাদের কাউকেই আইনের সম্মুখীন করা হয়নি। ফলে সবার কাছে উল্টো একটা বার্তা গেছে—দুর্নীতি করেও পার পাওয়া যায়।’
এ সুবিধাভোগী চক্র, রাজউকের দালাল চক্র, তাদের প্রভাব, সব মিলিয়ে এক ধরনের নেক্সাস তৈরি হয়েছে। অথচ হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা—ভবন ধসের ঘটনার পরে আমরা কঠোরভাবে বিল্ডিং কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করব, যারা এ নেক্সাসে ছিল তাদের চিহ্নিত করব, নতুন ভবন নির্মাণে কঠোর নিয়ম মানা হবে, জিরো টলারেন্স থাকবে।
রাজউক চেয়ারম্যানের বক্তব্য
ভূমিকম্পের পর নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় দ্রুতই ঢাকার সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম।
রাজউক জানায়, প্রতিটি অভিযোগ বা সংকটপূর্ণ ভবন পর্যায়ক্রমে যাচাই করা হবে এবং ঝুঁকির মাত্রা অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়াই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। পরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিস্তারিত তালিকা প্রস্তুত করা হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকারি স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের ১৪২টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি নিরূপণে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে রাজউকের কাছে তালিকা নেই।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার ছুটির দিনে সকাল ঠিক ১০টা ৩৮ মিনিটে হঠাৎ ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় পুরো দেশ। আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। একে একে আসতে থাকে হতাহতের খবর। সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এ সংখ্যা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সারা দেশে নিহত হয়েছে ১০ জন এবং আহত হয়েছেন ছয় শতাধিক।